বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঞ্চায়ন রয়েছে ১৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। যা মার্চের কর্মক্ষমতার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল— আইএমএফের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি কম। আইএমএফের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও রিজার্ভ বাড়াতে হবে। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু তাই নয়, ডলার বিক্রি করতে বাধ্য করে রিজার্ভ বাড়াচ্ছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ রয়েছে ১৯.৮৯ বিলিয়ন ডলার। যা থেকে ৪.৫ বিলিয়ন দায় বাদ দিয়ে মোট নেট রিজার্ভ প্রায় ১৫.৩৯ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের তথ্য বলছে, অক্টোবরে মোট রিজার্ভ ছিল ১৫.৯ বিলিয়ন, যখন গ্রস রিজার্ভ ছিল ২০.৩ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন জোরপূর্বক ব্যাংক থেকে ডলার কেনার মাধ্যমে রিজার্ভের ব্যবধান কমাতে মরিয়া। একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, কারেন্সি সোয়াপ মেকানিজমের অধীনে ডলারের বিনিময়ে অর্থ ধার করা বেশিরভাগ ব্যাংকই গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাদের ডলার বিক্রি করার জন্য মৌখিক নির্দেশনা পেয়েছিল। যাতে রিজার্ভ পুনর্গঠনে করতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, মুদ্রা অদলবদলের অধীনে ডলারকে স্বল্পমেয়াদি দায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যা গ্রস রিজার্ভকে প্রভাবিত করে। স্বল্পমেয়াদি দায় ব্যতীত নেট রিজার্ভ গণনা করা হয়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোকে তাদের ডলার বিক্রি করার পরামর্শ দিচ্ছে। যাতে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে ব্যবধান কমাতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত সপ্তাহে মোট কারেন্সি সোয়াপের পরিমাণ ১.৭ বিলিয়ন পৌঁছেছে। আটটি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানরা বলেন, অদলবদল চুক্তির মাধ্যমে পাওয়া ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশিরভাগ ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছে।
একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ট্রেজার বলেন, তাদের ব্যাংকের প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অদলবদল ব্যবস্থার অধীনে রয়েছে। এখন আমাদের দুই মাসের জন্য ডলার বিক্রি করতে বলা হচ্ছে। নেতিবাচক নেট ওপেন পজিশন থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের ডলার বিক্রি করার আহ্বান জানিয়েছেন বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
ব্যাংকাররা জানান, তাদের বৈদেশিক মুদ্রা নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমদানি অর্থপ্রদানের জন্য সংরক্ষিত ডলার রয়েছে, যা সাধারণত এক বা দুই মাস পরে বকেয়া হয়। তারা স্বল্প সময়ের জন্য অদলবদল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ওই ডলার দিয়েছিল। এখন যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই ডলার বিক্রির জন্য জোর করে, তাহলে আমরা আমাদের গ্রাহকদের আমদানি অর্থ প্রদান করতে সক্ষম হব না।
তারা আরও বলেন, যেহেতু তারা ডলার বিক্রি করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা তাদের সতর্ক করে বলেছিলেন তারা ডলার বিক্রি না করলে ভবিষ্যতে সহায়তা নাও পেতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোয়াপ সিস্টেমের মাধ্যমে প্রায় ২০টি ব্যাংক থেকে ১.৭৯ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। অদলবদল চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১.১ বিলিয়ন ডলার। তিনি ব্যাংক থেকে জোরপূর্বক ডলার কেনার বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, অনেক ব্যাংক তাদের অদলবদলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে ডলার পেয়েছে এবং সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে পারে, যা শুধু ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভর করে।
এদিকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত সপ্তাহে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের মৌখিকভাবে এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে উচ্চ মূল্যে ডলার কেনার নির্দেশ দিয়েছে। বিষয়টি একাধিক ব্যাংকার নিশ্চিত করেছেন।
গত সপ্তাহে রেমিট্যান্স রেট প্রতি ডলার ক্রয় করেছে ১১৫ টাকায়। যা আগের সপ্তাহে ১১২ টাকা ছিল বলে বাজারের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে। ডলারের উচ্চ মূল্য ২.৫ বিলিয়ন এর উপরে মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং আমদানিতে ব্যাপক পতনের কারণে গত দুই মাসে ডলারের তারল্যের উন্নতি হলেও, সরকারি আমদানি নিষ্পত্তির জন্য ক্রমাগত ডলার বিক্রির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ পুনর্গঠন করতে পারেনি বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে ডলার হোল্ডিংয়ে উন্নতি হলেও সরকারি রেট ও অনানুষ্ঠানিক হারের মধ্যে উচ্চ ব্যবধানের কারণে তারা সরকারি আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, সরকারি এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) প্রদানের ক্ষেত্রে, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যায় ১১০ টাকায় ডলার কিনতে, যার ফলে রিজার্ভ কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য তার মুদ্রানীতিতে অফিসিয়াল এবং অনানুষ্ঠানিক ডলার হারের মধ্যে ব্যবধান কমাতে মার্চের মধ্যে একটি ক্রলিং পেগ মেকানিজম চালু করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এটি রমজান মাস বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে পিছিয়েছে। কারণ নতুন পদ্ধতিতে ডলারের দর আরও ১ বা ২ টাকা বাড়বে। যা মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বরের পর থেকে টাকার অবমূল্যায়ন করেনি। কারণ বিপুল আমদানি কমানো ডলারের দামের ওঠানামা বন্ধ করে দিয়েছে। ডলারের ঘাটতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে ২০২৩ সালে আমদানি ২১ বিলিয়ন কমেছে যা শেষ পর্যন্ত ঘাটতি থেকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সকে উদ্বৃত্তে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট আমদানি ২৪.৩২ শতাংশ কমে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ৬৫.৩৯ বিলিয়ন হয়েছে। যা আগের বছর ৮৬.৪০ বিলিয়ন ডলার ছিল। চলতি বছরের জুলাই-জানুয়ারিতে চলতি অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স ৩ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ে ৪ বিলিয়নের বেশি ঘাটতি কাটিয়ে উঠেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের মার্চে আইএমএফের সর্বোচ্চ সীমা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। গত বছরের জুনে নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি না থাকা সত্ত্বেও আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় ধাপ পেয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কয়েকটি ব্যাংকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মার্কিন বাজারে বিনিময় হার ১১৪.৭৫ টাকা, কাতারে ১১৫ টাকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১১৫. ৫০ টাকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১১৪.৭৫ টাকা।
গত সপ্তাহে বাজারে প্রতি ডলারে বিনিময় হার ছিল ১১২ থেকে ১১৩ টাকা। এর আগে ১৮ মার্চ হঠাৎ করেই রেমিট্যান্সের হার ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা কমে যায়। কিছু ব্যাংক ১১৪-১১৪.৫০ টাকায় বৈদেশিক এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে রেমিট্যান্স ক্রয় করেছে, যা ধীরে ধীরে কমেছে ১১২ টাকায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে, এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো প্রায় এক বছর ধরে এ হার বজায় রেখে প্রতি ডলারে ১২০-১২২ টাকা রেমিট্যান্স রেট অফার করছিল। রেমিট্যান্স হারে হ্রাসের প্রবণতা সত্ত্বেও, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর ব্যাংকগুলোকে নামমাত্র মূল্যের চেয়ে সামান্য বেশি ডলার কেনার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ঈদের পর আবারও হার বাড়াতে বাধ্য হতে পারে ব্যাংকগুলো।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ