ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উদ্বিগ্ন ব্যাংক খাত

প্রকাশনার সময়: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫৮

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সংকটে ব্যাংক খাত। এ খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই অংশ শুরু করা হয়েছে একীভূতকরণ। আরও কিছু দুর্বল ব্যাংক একীভূত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে দুর্বল ব্যাংককে আরেকটা দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ প্রক্রিয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক ব্যাংক পরিচালক।

সম্প্রতি কনভেনশনাল ব্যাংক পদ্মা এবং শরীয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক একীভূত হওয়ায় এমন প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা ব্যাংক ছিল রেড জোনে, এক্সিমের অবস্থাও বেশি ভালো না। এমন দুটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত হয়ে ভালো ব্যাংক কীভাবে হবে সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। জানা গেছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এখন রীতিমতো ভয় পাচ্ছে সবল বা ভালো ব্যাংকগুলো। শক্তিশালী অবস্থানে আছে এমন ব্যাংকের ওপর দুর্বল কোনো ব্যাংককে চাপিয়ে দেয়া হবে কিনা তা নিয়ে ব্যাংকপাড়ায় চলছে নানা গুঞ্জন, নানা আলোচনা। এরই মধ্যে হঠাৎ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করায় নতুন বিতর্কের ডালপালা আরও ছড়িয়েছে।

সূত্র বলছে, তারল্য সংকট, মূলধন ঘাটতি, দুর্বল সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ঋণমান হ্রাসে ব্যাংক খাতের সংকট বড় হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের পুরো অর্থনীতি হিমশিম খাচ্ছে। তাই ব্যাংক খাত বাঁচাতে নতুন রোডম্যাপ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে ব্যাংক খাতের বড় সংস্কারের কথা বলা হয়। অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক একীভূত করা হয়েছে। এমন একীভূতের ঘটনায় ভালো ব্যাংকগুলো উদ্বিগ্ন ও বিভ্রান্তিতে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার জন্য দুর্বল ব্যাংকের তালিকা করেছে। দেশের ৫৪টি ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ৩৪টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্য থেকে আগামী বছরের শুরুর দিকে ১০ ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার কথা ভাবছে তারা।

৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ১২টি ব্যাংক খুব নাজুক অবস্থায় আছে। তার মধ্যে ৯টি রেড জোনে চলে গেছে। ইয়েলো জোনে থাকা ২৯টি ব্যাংকের মধ্যে ৩টি ব্যাংক আবার রেড জোনের খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে। মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে আছে। এর মধ্যে ৮টিই বিদেশি ব্যাংক। গ্রিন জোনে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৮টি।

একীভূত হওয়ার এ প্রক্রিয়ায় অনেক ব্যাংক পরিচালকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তাদের আশঙ্কা— কোনো দুর্বল ব্যাংক আবার চাপিয়ে দেয় কিনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, একীভূত করার যে প্রক্রিয়া— সেটা মোটেও ভালো ইঙ্গিত নয়। কখন কোন দুর্বল ব্যাংক ভালো ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দেয়— সেটা বলা মুশকিল। তাই বড় আশঙ্কার মধ্যে রয়েছি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সুশাসনের অভাব ও ব্যাপক ঋণ অনিয়মের কারণে ১০ থেকে ২০টি ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে, ব্যাংকিং খাতের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা কমে গেছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন অনিয়মের মধ্যে আছে— প্রভাবশালী মহলের চাপ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ অনুমোদন, ভুয়া কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ঋণ নেয়া এবং পরিচালকদের নিয়মবহির্ভূত আধিপত্য বিস্তার। এসব অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নয়া শতাব্দীকে বলেন, পদ্মা এবং এক্সিম দুটিই দুর্বল ব্যাংক। এ দুটি কীভাবে একীভূত হয়— জানি না। তাছাড়া পদ্মা হচ্ছে কনভেনশনাল ব্যাংক। আর এক্সিম হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। কনভেনশনালের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংক কীভাবে একীভূত হয় জানি না। তাহলে এখানে শরিয়াহ কোথায় গেল? এ ধরনের পদক্ষেপ অর্থনীতির জন্য বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, একীভূত করতে হলে কিছু প্রক্রিয়া আছে। সেগুলো ফলো করা উচিত ছিল।

প্রথমেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। তারপর তাদের অ্যাসেট-লায়াবেলিটি অডিট করে হিসাব করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক অডিটর হায়ার করে দেবে, তারা করবে। অডিটে হিসাব-নিকাশ করে বের করতে হবে প্রতিষ্ঠানের কতটা নেগেটিভ অ্যাসেট আছে। এরপর এই টাকাটা কে দেবে বা কোথা থেকে আসবে— সেটা ঠিক করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই লায়াবেলিটি কী এক্সিম ব্যাংক নিচ্ছে? সেই সক্ষমতা কী তাদের আছে? এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা কী তাতে রাজি? কেন রাজি হবে? এ ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এটা এক্সিম ব্যাংক কেন দেবে?

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে এমনটি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। তিনি বলেন, একীভূত হবার জন্য কোনো ব্যাংক আবেদন করলে আমরা সেটা বিবেচনায় নেই। এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার আবেদন করায় বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা মঞ্জুর করেছে। তিনি জানান, আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ