দু’সপ্তাহ ধরে পুঁজিবাজারে সূচক উঠানামার মধ্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা স্পষ্ট হলো লেনদেনে। চলতি সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো আর ১৪ কর্মদিবস পর প্রথমবারের মতো লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকার নিচে নামল। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস গত রোববার সূচকের পতনের পর দ্বিতীয় দিন গতকাল সোমবার উঠানামা করতে করতে শেষ পর্যন্ত ১৪ পয়েন্ট যোগ হওয়ার স্বস্তি উবে যাচ্ছে লেনদেন দেখে। আগের দিনের তুলনায় ২৭১ কোটি টাকার কম শেয়ার কেনা-বেচা হয়েছে। দিন শেষে হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ৭৬২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এই লেনদেন গত ২৭ জুলাইয়ের পর সর্বনিন্ম।
এর আগে শেষ দুই হাজার কোটি টাকার নিচে লেনদেন হয়েছিল গত ২৯ আগস্ট। সেদিনও দুই হাজার কোটি টাকার নিচে লেনদেন হয়েছিল ১৬ কর্মদিবস পর। ২৯ আগস্টের আগে লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকার নিচে হয়েছিল ২৭ জুলাই। সেদিন হাতবদল হয়ে ১ হাজার ৫২১ কোটি ৩১ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছিল। পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে ব্যাংকের অবণ্টিত লভ্যাংশ জমা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তি তোলার পর গত সপ্তাহ থেকেই পুঁজিবাজারে বিভ্রান্তি দেখা দেয়।
সূচকের উঠানামার ভিড়ে গত কয়েক মাসে যেসব কোম্পানির শেয়ারদর ব্যাপকভাবে বেড়েছিল, সেগুলো সংশোধনে যেতে শুরু করে। বড় মূলধনি ও বহুজাতিক কোম্পানির উল্লম্ফনে ওই সপ্তাহে সূচকের বড় পতন ঠেকানো গেলেও চলতি সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার পতন হয় বড় মূলধনি ও বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদরও। তবে একটি গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবণ্টিত লভ্যাংশ তহবিলে স্থানান্তর নিয়ে আপত্তি তুলে নিয়েছে। এরপর তহবিলে ব্যাংক থেকে টাকা আসছে। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কোনো আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি আসেনি। আর এই বিষয়টি নিয়ে তাই বিভ্রান্তি এখনো রয়ে গেছে।
এমনিতেই জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সূচক টানা বেড়েছে এক হাজার পয়েন্টের বেশি। ফলে একটি দর সংশোধন এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে হতে পারে বলে ধারণা ছিল। তার ওপর এই তহবিল সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়টি যোগ হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে, সেটি স্পষ্ট। আগের দিন ৩৬ পয়েন্ট পতনের পর গত সোমবার লেনদেনের শুরুটা বেশ ভালোই ছিল। বেলা সোয়া ১১টার দিকে সূচক প্রায় ৫০ পয়েন্ট বাড়ার পর ধারণা করা হয়েছিল, সেই মনস্তাত্ত্বিক চাপ থেকে বিনিয়োগকারীরা বুঝি বের হয়ে এসেছেন। তবে এরপরের সোয়া তিন ঘণ্টায় সূচক কেবল উঠানামা করতে করতে দিনের সেই সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে কমে যায় ৩৬ পয়েন্ট।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তির কারণে তহবিল নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল। কারণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন বিএসইসি তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিয়ন্ত্রক। কোনো আইনের কারণে তহবিলের অর্থ জমা হতে সমস্যা হলে পুরো পরিকল্পনাটি দুর্বল হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এখন যে কথাগুলো বলছে, সেটি আগে বলছে হয়ত এত জটিলতা হতো না। আর বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি হতো না।’
সূচকের লড়াইয়ের দিন পুঁজিবাজারে ঝলমলে দিন গেছে বিমা খাতে। সাধারণ বিমা কোম্পানির শেয়ারগুলো বহুদিন পর দল বেঁধে বাড়তে দেখা গেছে। দর বৃদ্ধির হারও ছিল উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি বস্ত্র ও প্রকৌশল খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ব্যাংক খাতে আরো একটি হতাশার দিন গেল। পতন হয়েছে খাদ্য, জ্বালানি, আর্থিক, ওষুধ ও রসায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও।
গত বছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এক দফায় এবং পরে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় বিমা খাতের শেয়ারগুলোর দল বেঁধে উত্থানের যে প্রবণতা দেখা দিয়েছিল, সেটি বহুদিন পর দেখা গেল আবার। সাধারণ বিমা খাতের ১৩টি কোম্পানির সবগুলো দর হারলেও সাধারণ বিমার ৩৮টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩৭টির। সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে দুটি ছিল এই খাতের। এর মধ্যে ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স ও বিএনআইসিএলের দর ছুঁয়েছে দিনের সর্বোচ্চ সীমা। এই খাতে দলের পাশাপাশি লেনদেনও বেড়েছে। সব মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ২৪৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার শেয়ার। আগের দিন লেনদেন ছিল ২০৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দর।
৯.৯৩ শতাংশ বেড়ে ১৩০ টাকা ৮০ পয়সার শেয়ার হয়েছে ১৪৩ টাকা ৮০ পয়সা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, যার শেয়ার দর ১২১ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৯.৯২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩৪ টাকা। সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার দর ৮.২৯ শতাংশ বেড়ে ৫৭ টাকা ৮০ পয়সা থেকে হয়েছে ৬২ টাকা ৬০ পয়সা।
দর বৃদ্ধির তালিকায় আছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স, নর্দান ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স। যাদের শেয়ার দর বেড়েছে ৪.৪৬ শতাংশ থেকে ৭.৭৬ শতাংশ পর্যন্ত।
এই খাতে জীবন বিমা খাতের প্রতিটি কোম্পানি দর হারিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩.৬৪ শতাংশ কমেছে রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ৩.৩৯ শতাংশ, মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ৩.৩২ শতাংশ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর ২.৯২ শতাংশ কমেছে।
৩২টি ব্যাংকের মধ্যে দর কমেছে ১২টির, বেড়েছে ৮টির। আগের দিনের দামেই আছে ১২টি। লেনদেন হয়েছে মোট ১০২ কোটি ৮ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৩০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। লেনদেনে ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংকের ৩.১৬ শতাংশ। শেয়ার দর ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ১২ টাকা ২০ পয়সা।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ