বেশ কয়েক মাস ধরে ইসলামী ধারার পাঁচটি ব্যাংক বড় ঘাটতিতে ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ সহায়তায় হঠাৎ করে এ ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত অবস্থায় ফিরে আসে। তবে শরিয়াহভিত্তিক এসব ব্যাংক আমানত বাড়াতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংকে যে হারে আমানত বেড়েছে— ইসলামী ব্যাংকগুলোতে সে হারে বাড়েনি। মূলত শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে সংঘটিত নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর আমানতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তারল্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসা ব্যাংকগুলো হচ্ছে— ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে ১০টি। অন্য ব্যাংকগুলো হচ্ছে— আইসিবি ইসলামিক, এক্সিম, শাহ্জালাল ইসলামী, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।
জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে সার্বিক আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে শরিয়ািভত্তিক ১০টি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের ইসলামি সেবাকেন্দ্রিক আমানত হচ্ছে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছিল ইসলামী ধারার ব্যাংকে।
গত বছরের মার্চে মোট আমানতে ইসলামী ধারার হিস্যা ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। তখন ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ২৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ধারার আমানত ছিল ৪ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা।
এদিকে আমানতে পিছিয়ে পড়লেও ঋণ বা বিনিয়োগে থেমে নেই শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংক। গত বছরের মার্চে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ২৮ দশমিক ১৫ শতাংশ ছিল ইসলামী ধারার, যা গত ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ৬৫৮ কোটি টাকার তারল্যঘাটতি ছিল। তবে গত ডিসেম্বর শেষে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। একই সময়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। অথচ গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটিতে তারল্যঘাটতি ছিল প্রায় ৮২৬ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরের শেষে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তারল্যঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে ইউনিয়ন ব্যাংকের তারল্যঘাটতি ছিল ৪৮৩ কোটি টাকা, তবে ডিসেম্বর শেষে উদ্বৃত্ত তারল্য দাঁড়ায় ২০০ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে তারল্য উদ্বৃত্ত হয় ৪০০ কোটি টাকা, এর আগে সেপ্টেম্বরে ঘাটতি ছিল ৪৬৫ কোটি টাকা।
জানা যায়, বার্ষিক আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে ২০২৩ সালের শেষ কার্যদিবসে এই পাঁচ ব্যাংকসহ মোট ৭টি বেসরকারি ব্যাংককে কোনো জামানত ছাড়াই প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই তারল্য উদ্বৃত্ত হয় পাঁচ ইসলামী ব্যাংকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ইসলামী ধারার অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৭০৫ কোটি টাকা ও আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। একটি ইসলামী ধারার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের অনিয়মের দায় পড়েছে এ ধারার সব ইসলামী ব্যাংকের ওপর। এর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চুপ থাকায় সবার জন্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। সে জন্য আমানতকারী অনেকেই অন্যান্য ব্যাংকে চলে যাচ্ছেন।
তাছাড়া আমানতে পিছিয়ে থাকলেও আমদানি বেড়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর। প্রায় দুই বছর ধরে পুরো ব্যাংক খাতের দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) তা কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর আমদানি বাণিজ্যে। গত অক্টোবর-ডিসেম্বর মেয়াদে এ ধারার ব্যাংকগুলোর আমদানি ১১৩ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৮০ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এ ধারার ব্যাংকগুলোর আমদানি বাণিজ্য ছিল ৩৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।
সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এ সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪২ হাজার ৮১৮ কোটি টাকার। আর আগের প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তুলনায় চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর আমদানি বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারল্য নিয়ে কিছুটা চাপে থাকলেও দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোয় ডলারের প্রবাহ বেশ ভালো। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশই এ ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে দেশে আসে। এ কারণে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হিমশিম খেলেও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পেরেছে।
শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ১০ ব্যাংকের বাইরে প্রচলিত ধারার ১৫টি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও ১৬টি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৫ শতাংশ ও মোট বিনিয়োগের (ঋণ) ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ৫৪ শতাংশই আসছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়সীমায় দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমদানি বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের। এ ধারার ব্যাংকগুলোর মোট আমদানিতে আল-আরাফাহ’র অংশ ছিল ৩৩ দশমিক ৪০ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১ দশমিক ৫৪ শতাংশ অবদান রেখেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। এছাড়া শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট আমদানিতে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৯ দশমিক ৫৬, এক্সিম ব্যাংক ৬ দশমিক ৮৬ ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ অবদান রেখেছে।
এক্ষেত্রে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের অংশগ্রহণ ছিল ১ শতাংশেরও কম। এছাড়া প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে ৭ দশমিক ১৪ ও ইসলামী ব্যাংকিং শাখার মাধ্যমে ৭ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়েছে।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বরাবরই ইসলামী ব্যাংক ‘মার্কেট লিডার’। নানা সংকট ও বিরূপ প্রচারণা সত্ত্বেও আমাদের ব্যাংকের ডলার প্রবাহ ভালো ছিল। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স থেকে আমরা পর্যাপ্ত ডলার পেয়েছি। আর আমদানির ক্ষেত্রে আমরা সরকারের নীতি অনুসরণ করেছি।
এক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের মতো চলতি বছরও ইসলামী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকখাতের অন্যন্য যে সমস্যা রয়েছে, তা দ্রুত কেটে যাবে।
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ জানান, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার ব্যাংক বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান শক্তি হলো রপ্তানি আয়। এ মুহূর্তে আমাদের ব্যাংকের রপ্তানি খাত ঋণাত্মক। প্রত্যাশা অনুযায়ী রেমিট্যান্স সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না।
মানি এক্সচেঞ্জগুলো ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ চাচ্ছে। যারা বেশি দর দিতে পারছে, তারাই রেমিট্যান্স বেশি আনছে। ডলার সরবরাহ কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না।’
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ