ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ঋণ করে ধার শোধ!

প্রকাশনার সময়: ১১ মার্চ ২০২৪, ০৮:১৩

চলতি অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিয়মিত ঋণ নিচ্ছে। বিশেষত ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। তবে এক খাত থেকে ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে পরিশোধ করছে সরকার। এর কারণে ছয় মাসে সরকারের নিট ঋণ তেমন বাড়েনি। এছাড়া নতুন বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ব্যাপারে উৎপাদনশীলতার ওপর গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

তথ্য মতে, সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে ওভার ড্রাফট (ওডি), সরকারি ডিপোজিট, সরকারি ল্যান্ডিং ফান্ড তথা ঋণ তহবিল এবং সঞ্চয়পত্রের ঋণ পরিশোধ করেছে। এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের অভ্যন্তরীণ নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৫৫ কোটি টাকা, যা তার আগের বছরের একই সময় ছিল ৩৭ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ওডি ঋণ পরিশোধ করেছে পাঁচ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে সরকারের ওডি ঋণ নেয়নি। আবার শোধও করেনি। অন্যদিকে এই ছয় মাসে সরকার ব্যাংক থেকে নেয়া ট্রেজারি বিলের দুই হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। একই সময়ে অভ্যন্তরীণ এ খাত থেকে ছয় হাজার ৫৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে এই ছয় মাসে ট্রেজারি বিলের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ১০১ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা।

এদিকে চলতি অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে বন্ডের মাধ্যমে নেয়া কোনো ঋণ পরিশোধ করেনি সরকার। বরং ছয় মাসে বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে তিন হাজার ৫৮৮ কোটি এবং ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সাত হাজার ৯৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ফলে এ খাত থেকে ছয় মাসে নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সরকারি ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের দুই হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সরকারি ডিপোজিট হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে বাণিজ্যিক সঙ্গে অধিদপ্তর ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের যে অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেগুলোর সঞ্চয়। গত বছরের একই সময়ে সরকারি ডিপোজিট থেকে চার হাজার ৮০৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। আবার এ ছয় মাসে সরকারি ঋণ তহবিলের তিন হাজার ২১১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। যদিও গত বছরের একই সময়ে এ খাত থেকে নিট ৭৪৭ কোটি টাকা নিয়েছিল।

এছাড়া সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট ছয় হাজার ৬৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১০৬ কোটি টাকা। এর বাইরে অন্যান্য খাত থেকে ছয় মাসে সরকার ঋণ নিয়েছে চার হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে আট লাখ আট হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল সাত লাখ ১৭ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। এক বছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ বেড়েছে ৯০ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের ঋণস্থিতি দাঁড়ায় তিন লাখ ৭৯ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় চার লাখ ২৮ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায়।

তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ তেমন বাড়েনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকার নিট ঋণ পেয়েছে মাত্র ৪৫৫ কোটি টাকা, যা তার আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঋণ পেয়েছিল ৩৭ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য উৎস থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা।

জানা যায়, বিদায়ী বছরের শুরু থেকে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। তাই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বন্ধের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বাড়লে তা পরোক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেয়া বন্ধ করে দেয়। তবে এ সময় সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পরিশোধ করছে। তাই চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ আগের তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে চার লাখ দুই হাজার ৩৬০ কোটি টাকায়, গত ৩০ জুন শেষে যা ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম সাত মাস ১৫ দিনে সরকারের নিট ব্যাং কঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৫৮১ কোটি টাকায়। অথচ গত ১ জুলাই থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় ছিল প্রায় ছয় হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮০ হাজার ২৩১ কোটি টাকায়, যা গত ৩০ জুন শেষে ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৪৪ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২২ হাজার ১২৮ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুন ছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ৩৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। আর এ ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।

এদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার হিসাবেও ঋণ পরিশোধ অনেক বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঋণ বাবদ ১৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গতবার এ সময়ে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ১৪০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, এখন যে বিদেশি ঋণ পরিশোধ হচ্ছে, তা আগের নেয়া। নতুন করে বিদেশি ঋণের প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াবে— এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত। তাহলে রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে না।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ