ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব। এছাড়া নামে বেনামে ঋণ দিয়ে বিপাকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এর সঙ্গে যোগ হয় তারল্য সংকট। ফলে ঋণ খেলাপি কমানো এবং ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে রোডম্যাপ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে কমপক্ষে ১০টি ব্যাংককে চাপ দিয়ে একীভূত করার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে এ চাপ প্রয়োগে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক ব্যাংক মালিক। তারা বলছেন, যাদের কারণে ব্যাংক খাতের এ অবস্থা— তারা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) নেতৃবৃন্দকে এ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকসহ ৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকরা অংশ নেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গভর্নর ব্যাংক মালিকদের একীভূত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং তারা কোন ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চান তা ঠিক করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি পূরণ করা হবে— তাই পরিচালকরা এই একীভূতকরণের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না বলে আশ্বস্ত করেছেন গভর্নর। দুর্বল ব্যাংকের পাশাপাশি সবল বা ভালো ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে বৃহৎ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠনের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে সভায় ব্যাংক পরিচালকদের পরামর্শ দেন গভর্নর।
বৈঠকে অংশ নেয়া ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর দুই শক্তিশালী বড় বেসরকারি ব্যাংক সিটি ও ইস্টার্ন ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন বড় ব্যাংক গঠন করা যেতে পারে বলে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বিএবির একটি সূত্র জানায়, দেশের শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে দেশে শরিয়াহভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ধারার ব্যাংকের সংখ্যা ১০। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ সংখ্যা পাঁচ-ছয়ে নেমে আসতে পারে। দেশের প্রথম প্রজন্মের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা চলছে। আবার চতুর্থ প্রজন্মের একাধিক ব্যাংকও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে পারে।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ (রাকাব) কয়েকটি ব্যাংক বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে দেয়ার বিষয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত কোনো আলোচনাই চূড়ান্ত রূপ পায়নি। তবে এবার সরকারি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সভাশেষে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে একীভূতকরণ নিয়ে যে উদ্বেগ ২০২৩ সালে শুরু হয়েছিল, তা দূর হয়েছে। কারণ এ ধরনের যে কোনো পদক্ষেপের উদ্দেশ্য কেবল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা। তিনি বলেন, গভর্নর আমাদের প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে দিয়েছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি, এতে কারও ক্ষতি হবে না। দুর্বল ব্যাংকগুলো শক্তিশালী হবে এবং ভালো ব্যাংকগুলো আরও ভালো হবে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশে ব্যাংকের একীভূত হওয়ার অনেক উদাহরণ রয়েছে। আমরা জাতীয় স্বার্থে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করব। বৈঠক সূত্র মতে, গভর্নরের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘যাদের কারণে ব্যাংক খারাপ হলো, তাদের তো কিছুই হলো না।’এর জবাবে গভর্নর বলেন, ‘একীভূত হলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের পাঁচ বছর পর্যন্ত পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখা হতে পারে।’
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকিং খাতের কল্যাণে আমরা ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করব। তিনি বলেন, চলতি বছরের মার্চের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর কোন ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তারপর সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে প্রণীত নীতিমালার আলোকে প্রক্রিয়া শুরু হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরও বলেন, আমাদের সামনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকদের নিজস্ব উদ্যোগে ব্যাংকগুলো একীভূত হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরাও চাই মালিকেরা সিদ্ধান্ত নিন। প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুরুর রহমান বলেন, বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর একীভূতকরণ আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী পরিচালিত হবে বলে তাদের আশ্বস্ত করেছেন।
তিনি বলেন, দুর্বল ব্যাংক কখনোই শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে চলতে পারে না। যেমন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমাদের ব্যাংক ভালো অবস্থানে আছে। আমাদের সঙ্গে একটি দুর্বল ব্যাংক চাপিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংক কোম্পানি আইন ২০২৩-এর সর্বশেষ সংশোধনীতে কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা আমানতকারীর স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কার্যকলাপে জড়িত থাকলে যে কোনো ব্যাংককে চাপ দিয়ে একীভূতকরণ শুরু করার ক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ সংশোধনীর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের ডিসেম্বরে দুর্বল পারফরম্যান্সকারী ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করতে প্রম্পট কারেকটিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক চালু করে। এটি নতুন কাঠামোর অধীনে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে সেগুলোকে নন-পারফর্মিং ঋণ এবং ঝুঁকিবারিত সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের অনুপাতের (সিআরএআর) ভিত্তিতে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ সম্পর্কে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করে সেখানে উল্লেখ করে, যদি একটি দুর্বল ব্যাংক একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়, তবে একীভূত হওয়ার পরের তিন বছর দুর্বল ব্যাংকের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হবে না।
রোডম্যাপে আরও উল্লেখ করা হয়, এ একীভূতকরণের লক্ষ্য হলো ব্যাংকগুলোর বোর্ডকে শক্তিশালী করা, মূলধনের ঘাটতি দূর করা এবং পরিচালন ব্যয় কমানো। দেশের ব্যাংকিং খাতে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ খেলাপি মোট ১৬ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের ৯ শতাংশ। গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ৯৩ শতাংশ ছিল মাত্র ১১টি ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় পৌঁছে। বর্তমানে দেশে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ৩৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স দেয়া ৯টি নতুন ব্যাংকের সবকটিই এখনো ওভারস্যাচুরেটেড বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন একটি ব্যাংক পদ্মা ব্যাংক বর্তমানে পতনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এটি একীভূত হওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। একই ধরনের আরেক ব্যাংক— এনআরবি গ্লোবাল— গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক নাম নিয়ে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্সের ব্র্যান্ডিংয়ের কারণে নতুন প্রজন্মের বাকি ব্যাংকগুলো এক দশক পরে এসেও বাণিজ্য অর্থায়ন পেতে হিমশিম খাচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টেনে না নিয়ে তাদের একীভূত করাই বাঞ্ছনীয়। কোন ব্যাংক একীভূতকরণের আওতায় আসবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সে নির্দেশনা দিতে হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হতে না চাইতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তাদেরকে জোর করে একীভূত করতে হতে পারে। দুর্বল ব্যাংকগুলো এগিয়ে না এলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা বা তাদের লাইসেন্স বাতিল করা যেতে পারে।
মনসুর বলেন, আন্তর্জাতিক রীতি হচ্ছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দেয়। যদি একটি সবল ব্যাংক অন্য একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায়, তাও হতে পারে। যদি একটি দুর্বল ব্যাংক একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়, তাহলে সরকার একটি অডিট ফার্মের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের ক্ষতির মূল্যায়ন করার পরে সবল ব্যাংকটিকে ক্ষতিপূরণ দেবে। কারণ সবল ব্যাংককে এই মন্দ সম্পদের বিপরীতে আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দুর্বল ব্যাংকের মালিকানা থাকবে না। সম্পদ গ্রহণের ফলে যে ক্ষতি হবে, তা তাদের পেইড-আপ মূলধন থেকে বাদ যাবে। এরপরও যদি কিছু থেকে যায়, তবেই দুর্বল ব্যাংকের পরিচালকেরা সমতুল্য শেয়ার ধারণ করবেন।
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমরা একীভূতকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে চাই। কোনো দুটি ব্যাংক নিজে থেকে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিলে সেটি বিবেচনায় নেয়া হতে পারে।’ ওই বৈঠকে গভর্নর ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ থেকে কমিয়ে ৪৫-এ নামিয়ে আনার ইঙ্গিত দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতার মধ্যেই ব্যাংক খাতে মার্জার-অ্যাকুইজিশন বিষয়ে নানা আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের সঙ্গে চতুর্থ প্রজন্মের একটি দুর্বল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার গুঞ্জন ওঠে। বিষয়টি নিয়ে ওই ব্যাংক পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়। আবার বেসরকারি খাতের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত পাঁচ-সাতটি ব্যাংকের সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূত করে দেয়া হতে পারে বলেও গুঞ্জন ওঠে। এ অবস্থায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অনেক উদ্যোক্তা বিএবি নেতাদের কাছে প্রকৃত অবস্থা জানতে চান। অনেকে মার্জারের বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএবির পক্ষ থেকে গত রোববার জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গত সোমবার গভর্নরের সঙ্গে বিএবি নেতারা বৈঠকে বসেন।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ