দীর্ঘদিন ধরে চলছে ডলার সংকট। মূল্যস্ফীতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কমানোর ঘোষণা দিলেও তাতে কাজে আসছে না। সঙ্গে রয়েছে বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ। এসব চাপের কারণে রমজান উপলক্ষ্যে পণ্য আমদানির পর্যাপ্ত ঋণপত্র খুলতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমছে। এসময় ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমেছে ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন এমনটাই দাবি করছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা হয়েছে ৩৯৭ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮১ কোটি ডলার বা ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল ৪৭৯ কোটি ডলারের।
সাম্প্রতিক সময়ে ডলার সংকটের প্রভাবে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমার পাশাপাশি পুরোনো এলসির দায় পরিশোধও কমেছে। আলোচ্য জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আগের এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২০ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছিল ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এসময় সবচেয়ে বেশি এলসি নিষ্পত্তি কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতির, যা ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আলোচ্য সময়ে এলসি খোলা কমার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইন্টারমিডিয়েট গুডস বা শিল্পের জন্য মধ্যবর্তী পণ্য। এসময় ইন্টারমিডিয়েট গুডসের এলসি খোলা হয় ২৬১ কোটি ১৮ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময় এ পণ্য আমদানির জন্য ৩০৫ কোটি ১১ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়। অর্থাৎ পণ্যটির এলসি খোলা কমেছে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।
এ তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে জ্বালানি পণ্য। জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে পণ্যটির এলসি খোলা হয়েছে ৫৩৮ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের। এর আগের বছরের একই সময়ে ৫৮৯ কোটি ৯০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়। এ সময়ে পণ্যটির এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) জানায়, অর্থপাচারের ৮০ শতাংশ হয় আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ‘আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসের’ মাধ্যমে এসব অর্থপাচার হয়। ব্যাংক যদি এটি বন্ধে সহযোগিতা না করে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
ডলার সংকটের কারণে খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমদানি পরিস্থিতি ঠিক রাখার পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে প্রায় ৯০০ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, দেশে রিজার্ভ এখন ২ হাজার ১৯ কোটি ডলার। জানা গেছে, ডলার সংকট মোকাবিলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় করতে আমদানিতে কঠোরভাবে লাগাম টানা হয়েছে। এতে উদ্যোক্তারা পণ্য আমদানির জন্য নতুন এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে সব ধরনের পণ্য আমদানির এলসি খোলা কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের মার্চে সর্বোচ্চ ৯৫১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল। এরপর থেকে এলসি খোলা কমেছে। তবে এবার নিয়ে ৩ মাসে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে এলসি হয়েছিল। এলসি কমায় আমদানিও কম হবে। বিশেষ করে শিল্প খাতের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি উপকরণের আমদানি কমায় এসব খাতে সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে শিল্পোৎপাদন কমে যাচ্ছে। নতুন শিল্প স্থাপন কম হওয়ায় কর্মসংস্থানের গতি একেবারেই শ্লথ। তবে এতে রিজার্ভের সাশ্রয় হয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পণ্য আমদানি কমলে শিল্পের উৎপাদন কমে যায়। আর শিল্পের উৎপাদন কমলে পণ্য সরবরাহ কমে যায়। এতে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। অপর দিকে পণ্য আমদানি বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমলে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন হয় না। অপর দিকে বিদ্যমান শিল্পকারখানার উৎপাদন কমে যায়। এতে দুই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। একটি হলো আমাদের শ্রম বাজারে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বর্ধিত কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়।
সেখানে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে না উঠলে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয় না। উপরন্তু বিদ্যমান শিল্পকারখানার উৎপাদন কমে গেলে মালিকরা শ্রমিক ছাঁটাই করতে থাকে। সবমিলেই কর্মসংস্থানের জায়গা কমে যায়। এতে বেড়ে যায় বেকারত্বের হার। তিনি মনে করেন, যে হারে পণ্য আমদানি কমছে, তা অব্যহাত থাকলে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে মোটেও সন্তোষজনক ফল বয়ে আনবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয় ৩৫.৪৪ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি তা আরও কমে হয় ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলার। তবে, আন্তর্জাতিক হিসেব পদ্ধতিতে (বিপিএম-৬) অনুযায়ী ওই দিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০.১৯ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের ঘরে নেমে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগে ডলার সংকট মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করত। কিন্তু এখন আর কোনো সহযোগিতা করা হয় না। এর ফলে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে এক দিকে তাদের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে আয়। ফলে তারা ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না।
বাধ্য হয়ে অনেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করছে। অপর দিকে ব্যাংকের অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলেই সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ