ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাড়ছে খেলাপির অনুপাত

প্রকাশনার সময়: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৫ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৯

নানা চাপে জর্জরিত দেশের অর্থনীতি। ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের সব খাতে। বাড়ছে পণ্যমূল্য, তারল্য সংকটে ভুগছে দেশের ব্যাংক খাত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পড়ছে টান। দেশের চলমান এ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে ব্যাংকিং খাতের ঋণ আদায়ে ধীরগতিও অব্যাহত আছে। ফলে এ খাতে খেলাপি ঋণের অনুপাত বেড়েছে। এক বছর আগে ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না। ঢালাওভাবে সুবিধা প্রদানের কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য গ্রাহকও বিপদে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯ শতাংশ। ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ৭০ শতাংশ।

তবে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমেছে ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত সপ্তাহে এটিকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে ও ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে একটি রোডম্যাপ নিয়েছে। ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এদিকে বিশেষ সুবিধা আর ছাড় দেয়ার পরও ব্যাংক খাতের এ ‘প্রধান সমস্যা’ দিনের পর দিন বাড়ছেই। ঋণসংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণ ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। গত বছরের মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। প্রথম তিন (জানুয়ারি-মার্চ) মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। গত বছরের জুনের তুলনায় এ বছর জুনে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।

করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় দেয়া হয়েছিল। ঋণ শোধ না করলেও গ্রাহককে ‘খেলাপি’ স্ট্যাটাস থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কম সুদে ঋণ নেয়া ও ঋণ পরিশোধে কিছুটা ছাড় ছিল ২০২২ সালেও। ২০২৩ সালে ঋণের কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে ছিল বিশেষ ছাড়। এমন সব সুযোগের পরও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না অনেক গ্রাহক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে দেশে পুনঃতফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ দশমিক ১১ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ অনেক বেশি। এর বাইরেও মামলার কারণে আটকা আছে আরও প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। তাই সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, খাতা-কলমে খেলাপি ঋণ যা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এ অঙ্ক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে অনেক বেড়ে যাবে। খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকলে ব্যাংক খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাবে। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে আমাদের তেমন সফলতা আসছে না।

এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। খেলাপি কমাতে না পারলে ব্যাংকগুলোর শাখা বন্ধের নির্দেশ দিতে হবে। শুধু ব্যাংক খাতেই নয়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণে রেকর্ড করেছে। দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা এ খাতের জন্য রেকর্ড।

আর এ রেকর্ড এনবিএফআই খাতের ব্যাপক ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ইঙ্গিত। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ৩৫টি এনবিএফআইয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা একই বছরের জুনের চেয়ে ৯ শতাংশ এবং আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ ছিল খেলাপি।

একই বছরের জুন শেষে যা ছিল ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এমন এক সময়ে এ তথ্য সামনে এলো যখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণ, ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা, সুশাসনের অভাবসহ অন্যান্য দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সাবেক চেয়ারম্যান, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বাহ্যিক চাপ ও সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে।

এ কারণে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এনবিএফআই খাতও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর থেকে এনবিএফআইগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছি। এতে এ খাতের খেলাপি ঋণের তথ্য সামনে আসছে। ঋণ অনিয়মের কারণে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৯ দশমিক ০২ শতাংশ। অনিয়মে জর্জরিত আরেক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এনপিএল) খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিআইএফসির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪৩ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৭ শতাংশ। জিএসপি ফাইন্যান্সের পরিমাণ ৭২১ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৮৭৯ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং আভিভা ফাইন্যান্সের ১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৭২ শতাংশ।

ঋণ অনিয়ম ও সুশাসনের অভাবের কারণে সম্প্রতি উত্তরা ফাইন্যান্স এবং ফিনিক্স ফাইন্যান্সের মতো কিছু এনবিএফআইয়ের বোর্ড ও পরিচালনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক করোনা মহামারির সময় ঋণ পরিশোধের দেয়া সুবিধা প্রত্যাহার করার পর এ খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ খাতের মোট ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ১০টি এনবিএফআইয়ের খেলাপি ৬৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ বা ১৪ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ও বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এনবিএফআই খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক করোনার সময় দেয়া সুবিধা প্রত্যাহারের পর খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ