বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা। রূপগঞ্জের পূর্ব সাব-রেজিস্ট্রার অফিস। এ অফিসে এখন আগের মতো আর ভিড় নেই। কারণ বাড়তি কর আরোপে কমেছে জমি বিক্রি। যেখানে আগে প্রতিদিন দলিল রেজিস্ট্রি হতো ১০০ থেকে ১২০টি। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ১৫টিতে। স্থানিয়দের দাবি, অনেক ক্রেতা জমি ও ফ্ল্যাটের টাকা জোগাড় করলেও নিবন্ধনের টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। আবার অনেকে জমি কেনার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছেন।
এতে সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়গুলোতে জমির দলিল নিবন্ধন অনেক কমেছে। আর দলিল রেজিস্ট্রি যা হচ্ছে— তার বেশির ভাগই হেবা। সাফ কবলা একেবারেই কমেছে। এতে করে দলিল লেখক, স্ট্যাম্প বিক্রেতা, জমি ক্রেতা ও বিক্রেতা— অসহায় হয়ে পড়েছে সবাই। আয় কমেছে সবার। সরকারও হারাচ্ছে শত কোটি টাকার রাজস্ব। গত ৭ মাস আগে যেখানে প্রতি মাসে রাজস্ব আদায় হতো গড়ে ৩৩ কোটি টাকা। সেখানে গত ৭ মাসে এসেছে ২০ কোটি টাকা। যা অতিরিক্ত কর আরোপের পূর্বের এক মাসের অর্ধেকেরই কম। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ম সংশোধন করে পূর্বের জায়গায় ফেরত যাওয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এমনিতেই আবাসন খাতে খারাপ অবস্থা চলছিল। বাড়তি করের বোঝায় পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের সব এলাকার সম্পত্তি নিবন্ধন কর দ্বিগুণ করে সরকার।
দেশের যে কোনো এলাকায় স্থাবর সম্পত্তি বা জমি ও ফ্ল্যাটের মালিকানা হস্তান্তরে দ্বিগুণ কর গুনতে হবে। আয়কর বিধিমালার ‘সম্পত্তি হস্তান্তর থেকে কর আদায়’ শীর্ষক ৬ নম্বর ধারা অনুসারে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি নিবন্ধন কর ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। যেখানে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, পোস্তগোলা ও গেণ্ডারিয়া এলাকায় দলিল মূল্যের ৮ শতাংশ বা আট লাখ টাকা করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ পূর্ব সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার মাইকেল মহিউদ্দিন আব্দুল্লাহ নয়া শতাব্দীকে বলেন, এক কাঠা জমির মূল্যের ওপর আগে উৎসে কর ছিল ৪ শতাংশ, এখন তা ৮ শতাংশ। এ কর বাড়ায় দলিল নিবন্ধন কমেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগের থেকে প্রায় ৫০ শতাংশের মতো কমেছে দলিল রেজিস্ট্রি। ক্রেতারা অতিরিক্ত কর দিয়ে জমি ক্রয় করতে পারছে না বলে দলিল রেজিস্ট্রি কমেছে।
রূপগঞ্জের দলিল লেখক আবু জাবের (বাবুল) বলেন, এখন আর আগের মতো দলিল রেজিস্ট্রি হচ্ছে না। চলতি বাজেটে অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে ক্রেতারা আগের মতো দলিল করছে না। এ অবস্থা গত ছয় মাস ধরে চলছে। সরকারের উচিত এদিকে নজর দেয়া। আগের যে নিয়ম ছিল সেখানে ফিরে যাওয়া।
তিনি বলেন, আগে ভ্যাট-ট্যাক্স মিলিয়ে জমির মূল্যের সাড়ে ৯ শতাংশ জমা দিতে হতো। এখন উৎসে কর বাড়ায় দিতে হচ্ছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। তাছাড়া দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। ফলে কমেছে জমি ক্রয়-বিক্রয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার কর বাড়িয়েছে। আর মানুষ জমি কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। দলিল লেখকদের বলার কিছু নেই। আগের থেকে ৯০ শতাংশ দলিল রেজিস্ট্রি কমেছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ (পূর্ব) সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের সামনে গত বুধবার কথা হয় জমির মালিক বাবুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, কর বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে আমাদের মতো সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। আমরা এখন জমি বিক্রি করতে পারছি না। ক্রেতারা অতিরিক্র এত টাকা দিয়ে জমি কিনতে চাইছে না। আমি জমি বিক্রি করে মেয়ে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম। অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে ক্রেতারা জমি কিনতে চাইছে না। তাই আমরাও বিক্রি করতে পারছি না। ফলে মেয়েও বিয়ে দিতে পারছি না। বিবাহযোগ্য মেয়ে নিয়ে আমি এখন বড় সমস্যায়। সরকারের উচিত হবে এ কর কমিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া। তাহলে আমরা জমি বিক্রি করতে পারব। আপনাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে আমাদের এ আবেদন যে, কর যেন কমিয়ে দেয়।
মফিজ উদ্দিন নামের এক জমি ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ইচ্ছে ছিল রূপগঞ্জের ইঠাপুর এলাকায় কিছু জমি কেনার। সব ঠিকঠাকও ছিল। নিবন্ধন করতে গিয়ে দেখি খরচ আগের থেকে অনেক বেশি। জমি নিবন্ধনের জন্য বাড়তি আরও এক লাখ টাকা দরকার। এ টাকা জোগাড় করা তার জন্য সময়সাপেক্ষ। তাই এখনই জমি কিনব না। যদি এ কর কমে— তাহলে কিনব, নইলে আমার পক্ষে জমি কেনা সম্ভব নয়।
জানা গেছে, এক কাঠা জমির মূল্যের ওপর আগে উৎসে কর ছিল ৪ শতাংশ, যা এখন ৬ শতাংশ। এ কর বাড়ায় দলিল নিবন্ধন কমে গেছে। গত বছরের জুন মাসে যেখানে রূপগঞ্জেই গড়ে ৩৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। সেখানে গত ৭ মাসে আদায় হয়েছে ২০ কোটি টাকা।
রূপগঞ্জ ও রূপগঞ্জ পূর্ব রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লিখক ও স্টাম্প ভেন্ডার কল্যাণ সমিতির ১ নং যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রমজান আলী নয়া শতাব্দীকে বলেন, আগে যে পরিমাণে দলিল হতো, এখন আর হয় না। অতিরিক্ত উৎসে কর আরোপের ফলে জমি ক্রয়-বিক্রয় কমেছে। গত ৬ মাস ধরে একই অবস্থা। এ আরোপিত কর না কমালে জমি বিক্রি বাড়বে না। আর জমি বিক্রি না বাড়লে দলিল লেখকরা বেকার সময় কাটাচ্ছে। আর এতে করে বেকায়দায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত সবাই। তিনি বলেন, এখন সবাই জমি বায়না করে রাখে পরে কিনবে বলে। অতিরিক্ত টাকার কারণে জমি ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে না। দলিল লেখকদের দাবি, যাতে এ নিয়ম সংশোধন করে আগের নিয়ম ফিরে যায়। তা না হলে দলিল লেখকরা বেকার হয়ে পড়বে।
আরেক দলিল লেখক জানান, এক গ্রাহক ৯০ লাখ টাকা দিয়ে জমি কেনার বায়না করেছিলেন। নিবন্ধনের জন্য দলিল প্রস্তুতও করা হয়েছে। এখন নিবন্ধনের কর আগের চেয়ে চার লাখ টাকা বেশি লাগবে। তাই জমি কেনা তিনি স্থগিত রেখেছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে নতুন করহার নির্ধারণ করে গত ২৬ জুন উৎসে কর বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করেছে। বিধিমালা অনুযায়ী, দেশের যে কোনো এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের মালিকানা হস্তান্তরে এলাকাভেদে ২৪ গুণ বা কোথাও আরও বেশি কর দিতে হবে। জমি, ফ্ল্যাট বা যে কোনো স্থাপনা নিবন্ধনের জন্য শুধু উৎসে কর হিসেবে কাঠাপ্রতি ৬০ হাজার থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। আগে এর পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা।
বিধিমালায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি নিবন্ধন কর ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকাসহ জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভায় এ কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যান্য পৌরসভায় কর ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ এবং বাকি এলাকাগুলোতে ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে।
রেজিস্ট্রি অফিসে কমেছে ভিড়: রূপগঞ্জ ও রূপগঞ্জ পূর্ব রেজিস্ট্রি অফিসে আগের কর্মব্যস্ততা দেখা যায়নি। রূপগঞ্জের স্টাম্প বিক্রেতা যীতেন সরকার বলেন, অতিরিক্ত কর আরোপের কারণে আগের মতো জমি দলিল হচ্ছে না। যা-ও হচ্ছে তার বেশির ভাগই হেবা। ২০টা দলিল রেজিস্ট্রি হলে তার ২ থেকে ৩টা থাকে সাফ কবলা।
হেবা দলিলে কর দিতে হয় না, তাই দলিল যা হচ্ছে তার বেশির ভাগই হেবা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্য সময় দলিল লেখকদের কক্ষগুলোতে দাঁড়ানোর জায়গা থাকত না। এখন সব কক্ষই ফাঁকা। তার কাছে থাকা স্ট্যাম্প, নোটিশ, নীল কাগজ বিক্রি হতো দিনে ৫০ হাজার টাকার। গত কয়েক দিন জমি বিক্রি অনেক কমে যাওয়ায় ভেন্ডারদের কাছে থাকা নিবন্ধন-সম্পর্কিত সরঞ্জাম বিক্রিও কমে গেছে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ