ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নিত্যপণ্য: স্বস্তিতে বাধা মনোপলি সিস্টেম!

প্রকাশনার সময়: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:১৭

বর্তমানে দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। জীবনযাত্রার খরচ সামলাতে হিমশিম খাওয়া সাধারণ মানুষ কি তাহলে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি? বড় আকারের শুল্ক ছাড়ে ভোক্তারা কম দামে চিনি কিনতে স্বস্তি পাবেন, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হয়েছে তার উল্টো। দাম তো কমেনি বরং প্রায় প্রতি মাসে বাড়ছে। বছরের ব্যবধানে খোলা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম বেড়েছে গড়ে ৩৫ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনির দাম একটু বেশি হলেও সংকট নেই। তবে, সরকার যদি আমদানি করে আমাদের মাধ্যমে সরবরাহ করে তাহলে দাম কিছুটা কমবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চিনি আমদানি ও সরবরাহে মনোপলি সিস্টেম ভাঙতে না পারলে বাজারে স্বস্তি ফেরার সম্ভাবনা নেই।

জানা গেছে, আমদানি শুল্ক অর্ধেক কমানোর পর এক টাকাও কমেনি চিনির দাম বরং বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে ৩৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৮ টাকায়। আর খোলা চিনি ১৪০ টাকা। বিশ্লেষকদের দাবি, চিনি আমদানিতে মনোপলি সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দাম কমানো কঠিন।

তথ্যমতে, চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণে গত বছরের নভেম্বরে আমদানি শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে আনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির প্রজ্ঞাপনে, অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে শুল্ক তিন হাজার থেকে কমানো হয়েছে দেড় হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনির শুল্ক ছয় হাজার থেকে করা হয়েছে তিন হাজার টাকা। শুল্ক ছাড় সুবিধা আমদানিকারকরা পাবেন আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ট্র্যাকিং সফটওয়্যার ব্যবহার পুরোপুরি চালু হলে তথ্যে কোনো ঘাটতি থাকবে না। তখন মিলগেট থেকে ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে কোন জেলায় কতটুকু পণ্য যাচ্ছে সেগুলো আমরা ট্র্যাক করতে পারব। এদিকে তেল ও চিনির মতো ছোলার বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছে কয়েকটি করপোরেট গ্রুপ। এমন অভিযোগ ছোট আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের। তাদের মতে, বড় আমদানিকারকদের আধিপত্যেই বাড়ছে ছোলার দাম। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কিছুটা বাড়তি হলেও রমজানে সরবরাহের সংকট হবে না। আর বিশ্লেষকদের মতে, এবার দেশি ছোলার মওসুমেই শুরু হচ্ছে রমজান। তাই দাম না বেড়ে বরং কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

দেশে ছোলার চাহিদা প্রায় আড়াই লাখ টন। দেশের কৃষক উৎপাদন করেন মাত্র কয়েক হাজার টন। আমদানি করতে হয় ৯০ শতাংশের বেশি। রাজধানীর পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের আমদানিকারকরা ছোলার বড় অংশের জোগান দিতেন। তবে, এবার বাস্তবতা ভিন্ন। আমদানি করতে তাদের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। তারা বলেন, অনেক বড় বড় পার্টি ২০০ থেকে ৩০০ গাড়ি মাল আগেই স্টক করে ফেলেন। বড় কয়েকটি আমদানিকারক সব নিয়ন্ত্রণ করছেন। বর্তমানে বাজারে ছোলার সরবরাহ ভরপুর থাকলেও রমজানের প্রায় দুই মাস আগে থেকেই বেড়ে গেছে ছোলার দাম। মানভেদে কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কিছুটা বাড়তি হলেও রমজানে সরবরাহের সংকট হবে না।

বাজার বিশ্লেষক কাজী হান্নান বলেন, এবার দেশি ছোলার মওসুমেই আসছে রমজান। কৃষকের ছোলা রমজানের বাজারে থাকবে। দেশীয় ছোলার সঙ্গে আমদানিকারকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এদিকে, রমজানে সারা দেশের এক কোটি মানুষের কাছে কম দামে ছোলা বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে টিসিবি। সংস্থাটির মুখপাত্র হুমায়ূন কবির বলেন, এক কেজি করে ১০ হাজার টন ছোলা কার্ডধারী ভোক্তাদের দেয়া হবে।

প্রতি বছর রমজানকে ঘিরে ছোলা ও চিনির মতো সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কায় থাকেন ভোক্তারা। এবারও তাই হয়েছে। প্রায় দেড় মাস বাকি থাকতেই লিটারে পাঁচ টাকা বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা। বিক্রেতাদের শঙ্কা, পুরোনো সেই স্টাইলে রমজানের আগে আরেক দফা দাম বাড়ানোর তৎপরতা চালাতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানকে সামনে রেখে ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই ক্রাইসিস দেখানো হয়। এ সুযোগে তারা দাম বৃদ্ধি করেন। ভোক্তা অধিদপ্তর ও গণমাধ্যম আসতে কিছুদিন সময় লাগে। আর এই সময়ে তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করে নিয়ে যায়। অপরদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, দাম বাড়তি থাকলেও সরবরাহ লাইন ঠিকঠাক আছে। বাজার এখন স্বাভাবিক। সব মিলে ডেলিভারিও ক্লিয়ার আছে। একই দাবি আমদানিকারকদেরও। তারা বলেন, সবারই মাল স্টক আছে। সংকটের কোনো কারণ নেই। সারা দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২১ লাখ টন। আর রোজায় চাহিদা ৪ লাখ টনের মতো। যার ৯০ শতাংশই আমদানি করে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ৮০ শতাংশ সয়াবিন তেল দুটি কোম্পানি এবং ২০ শতাংশ তিনটি কোম্পানির হাতে। বাজারে মনোপলি সিস্টেম চালু থাকলে কারসাজির দরকার হয় না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এইচ এম শফিকুজ্জামান জানান, তেল আমদানি, মজুদ ও সরবরাহের তাৎক্ষণিক তথ্য পেতে ট্রেকিং সফটওয়্যারের ব্যবহার শুরু করা হয়েছে।

বাজারে বর্তমান উচ্চমূল্যস্ফীতির লাগাম টানার লক্ষ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে টাকাকে আরও মূল্যবান করতে নীতি সুদ হার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি কমাতে তেমন অবদান রাখবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বাজারে কার্যকরভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থা ও সিন্ডিকেট উচ্ছেদের পাশাপাশি সরকারি ব্যয় কমাতে হবে।

নীতি সুদ হার মাত্র ২৫ পয়েন্ট বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কি সম্ভব? এই প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ সায়েম আমীর ফয়সাল বলেন, ‘আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার তারা কম করে হলেও ১০০ বেসিস পয়েন্ট প্রতিমাসে বৃদ্ধি করেছিল। এখন আপনি যদি প্রশ্ন করেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আসলে ২৫ পয়েন্ট বাস্তবসম্মত হবে কিনা? তাহলে আমি মনে করি তা গ্রহণযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনবে না।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার মান নিয়ন্ত্রয়ণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যতই পলিসি নিক; সরকারি ব্যয় কাটছাঁট আর সিন্ডিকেট নির্মূল করা না গেলে, তা কোনো কাজেই আসবে না। অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যয় কাটছাঁট করতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনা যদি কিছু লোকের হাতে চলে যায় এবং তারা যদি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব মুদ্রানীতি কোনো কাজে আসবে না।

এদিকে আইএমএফের ক্রলিং পেগ নীতি মেনে ডলারের বিনিময় হার আরও বাজারভিত্তিক করার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিশ্লেষকরা। আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত এবং মুদ্রানীতির কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যে স্বস্তির পাশাপাশি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ সায়েম আমীর ফয়সাল বলেন, যতই আমরা পলিসি ঘোষণা করি না কেন, যদি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের কঠোর পদক্ষেপ না থাকে তাহলে আকাঙ্ক্ষার জায়গায় পৌঁছতে পারব না। এদিকে অনেকেই জানান, তারা খাবার খরচ কমিয়েছেন এবং অতি জরুরি জিনিসপত্র ছাড়া অন্য কিছু কিনছেন না। তারপরও দৈনন্দিন খরচ মেটানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

গত জুলাইয়ে মোহাম্মদিয়া হাউজিং থেকে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের একটি কম ভাড়ার বাসায় উঠেছেন ২ সন্তানের জননী ফারজানা মাহবুবা। ৩ রুমের বর্তমান বাসার জন্য তাকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা। তার আগের বাসায় ছিল ৪টি রুম ছিল এবং ভবনটিতে লিফট ছিল। চার বছর আগে চাকরি ছেড়ে দেয়া ফারজানা বলেন, ‘বাসা ভাড়া ও অন্যান্য সার্ভিস চার্জসহ প্রতি মাসে ২৪ হাজার টাকা দিতে হতো। নতুন বাসায় আসার পর ছয় হাজার টাকা খরচ কমেছে।’ ফারজানার স্বামী বিদেশ থেকে যে টাকা পাঠান এবং তার যা সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই তিনি সংসার চালান।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ