নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কাজে দিচ্ছে। ব্যাংকমুখী হতে শুরু করেছে তহবিলের প্রবাহ। গত ডিসেম্বর মাসে আমানতের প্রবৃদ্ধি গত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। এ প্রবণতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের দাবি, ঋণের সুদহারে সীমা তুলে নেয়ায় গ্রাহকের আমানতের সুদহার বাড়ছে। যা অর্থনীতির জন্য একটা পজেটিভ দিক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের ১৪ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার তুলনায় যা বেশিই হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে পৌঁছায় ১১ দশমিক ০৪ শতাংশে। এ হার গত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে করোনা মহামারির বৈশ্বিক লকডাউন ও সে কারণে হওয়া অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার প্রভাবে আমানত প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে পৌঁছেছিল।
নাম না প্রকাশের শর্তে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, স্মার্ট রেট অনুযায়ী সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মাসের জন্য ব্যাংকের বিনিয়োগে (ঋণে) সর্বোচ্চ সুদহার ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরমধ্যে তারল্য সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক আরও প্রতিযোগিতামূলক হারে, সর্বোচ্চ ১১ থেকে ১২ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। আমানতে প্রবৃদ্ধির যা অন্যতম প্রধান কারণ। তিনি বলেন, অনেক ইসলামী ব্যাংকই ব্যাপক তারল্য সংকটে রয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বাধ্যতামূলক জমা সঞ্চিতির অনুপাত- নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা অনুপাত (স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও বা এসএলআর) রাখা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে উচ্চ সুদহার দিয়ে এসব ব্যাংককে আমানত আকৃষ্ট করতে হচ্ছে।
সুদহার বাড়ানোর সুফল পাচ্ছেন সঞ্চয়কারীরাও। এর আগে এক বছরের বেশি সময় ধরে আমানতের সুদহার ছিল মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে নিম্ন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানতের হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে পিছিয়ে পড়লেও- অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আমানতকারীরা সঞ্চয় করাকেই বেঁছে নিয়েছেন। তাছাড়া ব্যালেন্স শিট দৃঢ় করতে ব্যাংকগুলোও সাধারণত বছরের শেষদিকে এসে আমানত বৃদ্ধির লক্ষ্যে জোরেশোরে প্রচারণা চালায়। ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহারে এক অংকের যে সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহারের পরেই আমানতে সুদহার বাড়তে শুরু করে। গত বছরের জুনে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলেও— ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হয়। তবে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ হওয়ার পরেও প্রধান প্রধান ব্যাংকগুলো আমানতে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যসূত্রে এমনটাই জানা গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঋণের সুদহারে সীমা তুলে নেয়ার কারণে গ্রাহকের আমানতের সুদহার বাড়ছে। আমাদের অর্থনীতির জন্য এটি একটা পজেটিভ দিক। তিনি বলেন, পলিসি রেট (নীতি সুদহার) বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের সুদহারে তার কিছুটা প্রতিফলন তৈরি হয়েছে। যদিও এখনো মূল্যস্ফীতি রেটের তুলনায় আমানতের রেট কম। আমানতের রেট আরও বাড়াতে হলে লেন্ডিং রেট (ঋণের সুদহার) আরও বাড়তে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, নতুন চালু করা সংকুলানমূলক মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের তহবিল ব্যাংকে নিয়ে আসা। যা মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার সহায়ক হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ‘মেজর ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ শীর্ষক মাসিক প্রকাশনায়— সঞ্চয় এবং মেয়াদি আমানত বৃদ্ধির কৃতিত্ব দিয়েছে আমানতের সুদহার বাড়া এবং ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমে আসাকে। এসব বিষয়কে সেখানে মূল অনুঘটক বলে উল্লেখ করা হয়।
মেজবাউল হক বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে অবশ্যই প্রভাব পড়বে, কারণ আমরা চাচ্ছি ঋণের প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে অর্থের জোগান কমিয়ে আনতে। যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে তখন পুনরায় প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়বে।
২০২৩ সালের জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার সীমা তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্মার্ট রেট ঘোষণা করেছে। সেপ্টেম্বরে সুদহারের ব্যবধানের (স্প্রেড) সীমাও তুলে নেয়া হয়। সুদহারের ব্যবধান হলো— ব্যাংকগুলো বেসরকারি গ্রাহকদের যে সুদে ঋণ দেয়, তা থেকে বাণিজ্যিক বা অন্যান্য ব্যাংক ডিমান্ড, মেয়াদি, বা সঞ্চয়ী আমানতের বিপরীতে আমানতকারীকে যে হারে সুদ দেয়— তা বাদ দিলে যা পাওয়া যায়, সেই পার্থক্য। ব্যাংকাররা বলছেন, এসব পদক্ষেপের কারণে ব্যাংকগুলো এখন উচ্চ সুদহারে আমানত নিতে পারছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে গ্রাহকের ঋণের রেট পরিবর্তন হচ্ছে ছয়মাসের ট্রেজারি-বিল বন্ডের গড় রেটের (স্মার্ট) ওপর ভিত্তি করে। এরসঙ্গে আরও ব্যাংকগুলো ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে গ্রাহকে ঋণ দিতে পারে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির জন্য ঋণের সর্বোচ্চ রেট হবে ১২.৪৩ শতাংশ। তিনি বলেন, যখন ঋণ-আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) ৪ শতাংশ রাখার সীমা ছিল। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলো চাইলে ১ শতাংশের কমও স্প্রেড রাখতে পারে। যে কারণে ব্যাংকগুলো আমানতের জন্য উচ্চ সুদহার দিতে পারছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমেছে ৩৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
এ বছরের জানুয়ারিতে, চলতি অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে যেখানে বাজারে অর্থের জোগান কমানোর পদক্ষেপ ছিল।
অর্থের সরবরাহ আরও আঁটসাঁট করা হলে— তখন আমানতের সুদহার আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে সঞ্চয়ের ওপর ভালো সুদ পেয়ে আমানতকারীরাও লাভবান হবেন। চলতি অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশেরও কম হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ এর জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ভোক্তা ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে নেতিবাচক শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ। সে তুলনায়, আগের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
দেশের অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ ভবিষ্যতের কথা ভেবে খরচ কমিয়ে সঞ্চয়ে আগ্রহী হচ্ছে— এমন চিত্রই উঠে এছে মোটরযান, মোবাইল, পোশাক, জুতা, সিমেন্ট, সিরামিকস ইত্যাদি পণ্যের বিক্রি কমার তথ্যে। যে কারণে ভোক্তা ঋণের চাহিদাও কমেছে। তবে আমানত বাড়লেও, ব্যাংকগুলো এখনো গভীর তারল্য সংকটের মধ্যে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারা দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ধার করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়ানোর পরে— এক ব্যাংকের অন্য ব্যাংক থেকে এক দিনের জন্য সুদে টাকা ধারের হার— অর্থাৎ গড় কল মানি রেট দাঁড়িয়েছে ৯.৬০ শতাংশে। এটি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২৮ জানুয়ারি কল মানিতে ৩ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ধার নেয় ব্যাংকগুলো। এই চাহিদার ফলে কল মানি বাজারে গড় সুদহার পৌঁছায় ৯.৬০ শতাংশে। ২০১৩ সালের পর যা সবচেয়ে বেশি।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ