খেলাপি ঋণ কমাতে ১১ দফা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এসব খেলাপির বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে। তারা নতুন করে জমি বাড়ি গাড়ি কিনতে পারবেন না, এমনকি নতুন ব্যবসাও খুলতে পারবেন না। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ডেপুটি গভর্নর জানান, ব্যাংকিং খাতে ২০২৬ সালে ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সার্বিক ৮ শতাংশের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ১০ ও ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সীমাতিরিক্ত, বেনামি স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং জালিয়াতি, প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ১১ দফা রোডম্যাপ করা হয়েছে।
ডেপুটি গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলে তাকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করবে। এ খেলাপিদের সমাজে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ তৈরি হবে। আগামীতে খেলাপিরা জমি কিনতে গেলে রেজিস্ট্রশন করতে পারবে না।
নতুন প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানি চালু কিংবা ব্যবসা সম্প্র্রসারণ করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিঠি দেবে যেন তাদের কোনো সহযোগিতা না করে। গাড়ি-বাড়ি কিনতে পারবেন না। এমন অবস্থায় পড়তে কোনো ব্যবসায়ী চাইবে না। তাই তারা ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করবে।
বেনামে ঋণ কত জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর বলেন, বেনামে ঋণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তাই কত আছে এর সঠিক তথ্য নেই। পত্রপত্রিকায় বেনামে ঋণের তথ্য আসছে তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে যেহেতু লিখা হচ্ছে কিছু না কিছু আছে, এটি চিহ্নিত করা হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং আইন বজায় রেখে ও গত তিন বছরের শ্রেণিকৃত ঋণের তথ্য পর্যালোচনা করে ১১ দফার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে পরলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তিনি আরও বলেন, দুর্বল ব্যাংক সংস্কারের বড় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূলধন খেলাপি ঋণসহ চারটি সূচকের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে। সবল কোনো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হবে। গত ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকগুলোকে বলে দেওয়া হয়েছে যারা দুর্বল তারা আগে থেকে প্রস্তুতি নেবে কার সঙ্গে একীভূত হবে। যদি কেউ এ ধরনের প্রস্তুতি না নেয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে একীভূত করে দেবে।
এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে শীর্ষ খেলাপির তালিকায় এমন অনেক গ্রাহক আছে, ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ কত জানতে চাইলে ডেপুটি গভর্নর বলেন, পুরো তথ্যটা নেই তবে ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে আছে। একজন পরিচালক ব্যবসায়ী হিসাবে ঋণ নিতেই পারেন যদি তিনি অন্য কোনো যোগাযোগের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি না করে। অপর প্রশ্নের জবাবে ডেপুটি গভর্নর জানান, ঋণের ২ শতাংশ দিয়ে বিশেষ সুবিধার আওতায় খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তখন ৭৯০ কোটি টাকার ডাউনপেমেন্ট আদায় হয়। ওই সময় তারল্য সমস্যা ছিল।
যদি এ সুবিধা দেয়া না হতো তাহলে এ টাকাও পেত না ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং খাতে ২০২৬ সালে ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে নতুন রোডম্যাপ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি খেলাপি ঋণ কমানো আরেকটি করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করা।
তফসিলি ব্যাংকের কোনো ঋণ দুবছর মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত থাকলে তা অবলোপন (রাইট অব) করা যাবে। তবে সেসব ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হবে। বর্তমানে ৩ বছর মন্দ বা ক্ষতিজনিত মানে শ্রেণিকৃত থাকলে ঋণ অবলোপন করার সুযোগ রয়েছে।
এর ফলে খেলাপির পরিমাণ ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অবলোপন করা ঋণ আদায়ের জন্য দেশের প্রত্যেকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করা হবে।
মন্দ ঋণ এবং রাইট অব করা সম্পদ বিক্রির জন্য বেসরকারি খাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন করা হবে। এ আইনটি খসড়া করা হয়েছে, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
এ আইনের ফলে ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালেন্স শিট পরিষ্কার করতে পারবে এবং প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকের আয় খাতে দেখাতে পারবে। মন্দ, অবলোপন, পুনর্গঠন করা ঋণ বা স্টিজ অ্যাসেটের বিপরীতে আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় না করে আয় খাতে দেখানো যাবে না। স্টিজ অ্যাসেট আদায় বা নিয়মিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যালেন্স শিটে দেখাতে পারবে না।
কারণ এ অ্যাসেট ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণে পরিণত হতে পারে। মহামারি করোনা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ঋণ পরিশোধের জন্য দেয়া বিভিন্ন বিশেষ সুবিধার মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।
মেয়াদি ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার সংজ্ঞা, এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন ও পরিপত্র সংশোধন অথবা হালনাগাদ করার মাধ্যমে আর্থিক খাত সংস্কারের শর্ত পূরণ হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যেখানে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিদ্যমান লিগ্যাল টিম বা আইন বিভাগকে শক্তিশালী করা হলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
ব্যাংকের অনাদায়ী অর্থ দ্রুত আদায়ের লক্ষ্যে অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর আওতায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের লাগাম টানতে ব্যাংক-কোম্পানি (সংশোধন) আইনে সংজ্ঞায়িত ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যেসব কর্মকর্তা কাজ করবে তাদের বিশেষ ভাতা দেয়া হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নিজস্ব মূল্যায়নের পাশাপাশি তালিকাভুক্ত জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করবে।
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ