ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চাল সিন্ডিকেটে সেই তিন নাম

প্রকাশনার সময়: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৩:৫৫
সংগৃহীত ছবি

চালের বাজার অস্থিরতার পেছনে কাজ করছে একটি শক্তিশালি চক্র। এই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশের বৃহৎ তিন মিল মালিক। তারা বাজারে ধানের দাম বাড়ার অজুহাতে চিকন চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

তাদের চক্রে রয়েছেন পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারাও। এমন পরিস্থিতিতে সঠিক তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দেয়া ওই প্রতিবেদনের একটি কপি নয়া শতাব্দীর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

যদিও এর আগেও এই চক্রের নাম সামনে এসেছিল। তবে সে সময়ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম ও মনিটরিং গতিশীল করার সুপারিশ করা হয়েছে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বেশ কিছুদিন ধরেই ধানের দাম কমলেও চালের বাজার আগের মতোই চড়া রয়েছে। বিশেষ করে চিকন চালের দর কেজিপ্রতি ৬-১০ টাকা বেড়েছে। মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত। এতে সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। ধানের জোগান স্বাভাবিক থাকলেও চালের বাজার চড়া হওয়ার নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে বাজার সংশ্লিষ্ট ও গোয়েন্দারা এই বিশেষ সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চক্রটি হচ্ছে দেশের চালের সর্ববৃহৎ মিল মালিক কুষ্টিয়ার আব্দুর রশিদ, নওগাঁর আলহাজ বেলাল হোসেন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের এরফান আলী।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ধানের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরে ধানের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে তারাই চালের দাম বাড়িয়েছে। কেবলমাত্র ব্যাপক চাহিদা থাকা মিনিকেট (চিকন চাল) চালের ক্ষেত্রে তারা এ কৌশল অবলম্বন করেছে। এ সুযোগে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করেছেন। কিন্তু চালের দাম বাড়িয়ে কত টাকা সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু উল্লেখ নেই। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের একটি কপি হাতে এসেছে। প্রতিবেদনটি গত সপ্তাহে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জমা দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আব্দুর রশীদ ও তার পরিবারের সদস্যরা এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে পুরো পরিবার আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। রশীদের ভাই সিদ্দিকুর রহমান কুষ্টিয়া মিরপুরের আইলতাড়া ইউনিয়নের আওয়ামীপন্থি চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি বিএনপিপন্থি চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

অপরদিকে, সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য নওগাঁর আলহাজ বেলাল হোসেন ‘বেলাকোন’ গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও সরকারদলীয় নেতাদের সঙ্গে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সিন্ডিকেটের অপর সদস্য এরফান আলী চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য এ তিন মিল মালিকের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে তারা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করছে।

গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুর রশিদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বেলাল হোসেনের ম্যানেজার আলাল হোসেন প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন। একইসঙ্গে চালের দাম বাড়ানোর পেছনে তাদের কোনো হাত নেই বলেও উল্লেখ করেন।

এরফান আলী দাবি করেন, তিনি কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত নন। চিকন চালের (মিনিকেট) চাহিদা বেশি থাকায় এক সময় দাম বেড়েছিল, তা আবার কমে গেছে। তিনি বলেন, তারা আড়তদারের কাছে চাল বিক্রি করেন। তারপর আরো তিনটি হাত বদল হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ওই তিন হাতে যদি চালের দাম বাড়ায় তাহলে তাদের কী করার আছে?

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। এ দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার সুযোগে অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাই চালের দাম মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার জন্য সরকার গৃহীত বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলোকে গতিশীল করতে হবে। দাম নিয়ন্ত্রণে মিল মালিক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই যেন সিন্ডিকেট গঠন না করতে পারেন, সেদিকে নিরীক্ষণ ও নজরদারি বাড়াতে হবে। এছাড়া চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম ও মনিটরিং গতিশীল করার সুপারিশ করা হয়েছে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

এদিকে, বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নানজীন আহমেদ সম্প্রতি চালের বাজার নিয়ে এক গবেষণায় দাবি করেছেন, মজুত আইন অনুযায়ী ধারণ ক্ষমতার পাঁচ গুণ ধান ৩০ দিন এবং দ্বিগুণ চাল ১৫ দিন পর্যন্ত মজুত করা যায়। এটি মানছে কি না সেটি মনিটরিং করতে হবে। দেশে মোট চালের ২০ শতাংশের মতো মজুত করতে পারে বড় ৫০টি মিল। এখানে মনিটরিং জোরদার করতে হবে যাতে কোনো মিলার বেশি সময় ধান বা চাল আটকে না রাখতে পারেন।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত রোববার মিনিকেট চালের বাজার দর ছিল ৬৫-৬৮ টাকা। যা এক মাস আগেও ছিল ৫৫-৫৮ টাকা। এ হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে অন্তত ১০ থেকে টাকা। মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৫২ টাকা। যা কিছুদিন আগেও ছিল ৪৭ টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই। গত বোরো ও আউসের মৌসুমেও ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়েছে। এখন মাঠে আছে আমন ধান। বন্যা না হলে আমনেও ভালো ফলনের আশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

কিন্তু ইতিবাচক এত খবরের পরও অস্থির হয়ে উঠেছে চালের বাজার। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৫২ টাকায় উঠেছে। এই দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্য চালের দামও বাড়তি। ফলে এই করোনা মহামারির মধ্যে বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। কারসাজি চক্রের কারণেই চালের দাম বাড়ছে। বেশি লাভের আশায় মিলার ও মজুতদাররা ধান, চাল মজুত করে রেখেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় বাজারে ধান-চালের সরবরাহ কম। এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, চালের দাম কমাতে সরকার সারাদেশে ওএমএস চালু করলেও বাজারে তা কোনো প্রভাব ফেলছে না।

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও বলেন, ‘নব্য মজুতদারদের’ কারণে চালের দাম বাড়ছে। করোনার কারণে অন্য ব্যবসায় মন্দা থাকায় অনেক ব্যবসায়ী ধান, চাল কিনে মজুত করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জানা গেছে, দেশে চালের সবচেয়ে বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। গত কিছু দিন ধরেই এই মোকামসহ অন্যান্য মোকামেও চালের দর বাড়তি। ধানের ব্যাপক মজুত গড়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দর বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ দেশের অটো রাইস মিলের মালিকসহ অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে বর্তমানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল ২ হাজার ৮৫০ টাকা, বাশমতি ৩ হাজার ৩৫০ টাকা, কাজললতা ২ হাজার ৬০০ টাকা ও মোটা জাতের ব্রি-২৮ ও স্বর্ণা ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মণপ্রতি চালভেদে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেশি। অন্য মোকামের অবস্থাও একই। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ