মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মূল্যস্ফীতিই এখন দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতিতে বাগে আনতে ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে চলতি বছরে আগস্ট থেকে শুরু হয়ে ধারাবাহিকভাবে পঞ্চম মাসে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। চলতি মাসে ভোক্তা ঋণের সুদহার হবে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণের সুদের হার বাড়াতে কিছুটা সময় লাগলেও তা বাড়ানোর ঘোষণার পর আমানতের সুদের হার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে আমানত বাড়বে। শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে আছে। অন্যদিকে আবার কয়েকটি ব্যাংকে তারল্য ঘাটতি নেই। এ অসামঞ্জস্যতা বাজারে চাপ সৃষ্টি করেছে।
যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, তা হলো ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ তথা— সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত। প্রতি মাসের শুরুতে এ হার জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদহার (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২০ শতাংশ এবং অক্টোবরে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সবশেষ নভেম্বরে স্মার্ট রেট বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭২ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, অক্টোবর মাসের ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে এখন সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ডিসেম্বর মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। অন্যদিকে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ করতে পারে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অবশ্য একবার সুদহার কার্যকর করা হলে পরবর্তী ছয় মাসে তা আর পরিবর্তন করা যায় না।
নভেম্বরে মাসের ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ডিসেম্বর মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। সেই হিসেবে, চলতি ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণের সুদহার হবে ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর কৃষি ও পল্লি ঋণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুদ নিতে পারবে।
গতমাসে অর্থাৎ নভেম্বরে বড় অঙ্কের ঋণে সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ, প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং কৃষি ও পল্লি ঋণের ক্ষেত্রে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তবে ডিসেম্বরে ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে ব্যাংক নিতে পারবে ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ সুদ। কারণ সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নেয়া সুযোগ রয়েছে। যা আগের মাস নভেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
ব্যাংকের ক্ষেত্রে শুধু ঋণে সর্বোচ্চ সীমা থাকলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত সংগ্রহেও সুদহারের একটা সর্বোচ্চ সীমা দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ যোগ করে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। ‘স্মার্ট’ রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ঋণের বিপরীতে সুদ নিতে পারবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এনবিএফআই। সেই হিসেবে ডিসেম্বর মাসে তাদের সর্বোচ্চ ঋণের সুদহার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং আমানতে ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে ডিসেম্বরে ঠিক করা ঋণের এ সুদহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদহার প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, গত জানুয়ারিতে স্মার্ট ছিল ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এরপর প্রতি মাসে একটু করে বেড়ে গত মে মাসে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। জুন ও জুলাইয়ে সামান্য কমে ৭ দশমিক ১০ শতাংশে নামে। এরপর আগস্ট থেকে ধারাবাহিক সুদহার বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ৯০ দশক থেকে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে বাজারভিত্তিক সুদহার ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা আরোপ করা হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন পর্যায় থেকে সীমা তুলে নেয়ার জন্য বলা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও সুদহারের সীমা প্রত্যাহার অথবা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সরকারের ইতিবাচক সায় না পাওয়ায় নীরব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত সুদহার বাজারভিত্তিক করা। সেই শর্তের আলোকে নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এতদিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে।
সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুন ও জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমার পর আগস্ট, সেপ্টেম্বরে মাসেও তা আবার বেড়েছে। সবশেষ গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিএস এর মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে।
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ