ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
হরতাল-অবরোধ

ক্ষতির মুখে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য

প্রকাশনার সময়: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৪৮

মহামারি করোনার পরেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতিতেও আঘাত হানে। এরপর আবার নতুন করে শুরু হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। এ যুদ্ধও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এমন অবস্থায় আমদানিমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান দেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোনোটাই বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে হরতাল-অবরোধ ও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ। আর এতেই স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে বাধাগ্রস্ত হয়েছে আমদানি-রফতানি, উৎপাদন, বিপণনসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপির হরতাল-অবরোধের ১৭ দিনে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। পরিবহন খাতে ক্ষতি হয়েছে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ সময়ের মধ্যে সড়কে যানবাহন চলাচল করতে না পারায় ক্ষতি হয়েছে ১২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এই কয়েক দিনে ঢাকাসহ সারাদেশে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়েছে ৪০৮টি। একই সঙ্গে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বাস বন্ধ ছিল এবং ট্রাক বন্ধ ছিল ৬০ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, রাজনৈতিক এই অস্থিরতা চলতে থাকলে পরিবহন খাত আরও বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বে। দেশের সম্পদ কেন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা নষ্ট করা হচ্ছে? এখনও অনেক পরিবহন মালিক আছেন, যারা গরিব। তার মাত্র একটি যানবাহন রয়েছে, যেটি দিয়ে তার সংসার চলে। তিনি হয়তো বিএনপিই সাপোর্ট করেন। যদি তার গাড়িটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তিনি তো রাস্তার ফকির হয়ে যাবেন। কাজেই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করুন।

এদিকে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, একদিনে হরতাল-অবরোধে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতি এক থেকে দেড়শ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, মানুষের স্বস্তিতে ফিরে আসার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। একটি আশার আলো দেখা দেওয়া শুরু হয়েছিল। মানুষ আবার স্বস্তির মধ্যে ফিরে আসবে। বর্তমানে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আবার আমাদের মধ্যে চরম শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে হরতাল-অবরোধ ও বৈশ্বিক নানা সংকটে গত ৬ থেকে ৭ মাসে এ খাতের ব্যবসা কমেছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। সংগঠনটি বলছে, ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল, যা দেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এই সংকটের কারণে আমরা নীতিগত সহযোগিতা নিয়ে বেকায়দায় থাকব। আবার বায়াররাও আসতে চাইবে না। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে এ রকম নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে থাকবে। তখন এ সংকট আরও ঘনীভূত হবে। পোশাকসহ পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, মৎস্য, কৃষিপণ্যসহ রফতানিতে ভূমিকা রাখা সব খাতেই রফতানি আয় কমতির দিকে। হরতাল-অবরোধের কারণে শিল্পকারখানার উৎপাদন ও সরবরাহে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পোশাক শিল্পের মালিক বলেন, চলমান হরতাল-অবরোধে আমদানি-রফতানিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটে আমরা আরও বেশি সমস্যায় পড়েছি। বিদেশি গ্রাহকদের চাহিদাপূরণ করতে পারছি না। পণ্য সরবরাহে পরিবহন না চলায় দ্বিগুণ ভাড়ায় পণ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে গেলে সবদিকেই আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি।

তিনি বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে না এমন রাজনীতি করা। কারণ, দেশের অর্থনীতি ভালো না গেলে মানুষ ভালো থাকবে না। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, অনাকাঙ্ক্ষিত এই তিন পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে ভয়ানক অবস্থা তৈরি করেছে। এরমধ্যে হরতাল-অবরোধের রাজনীতি দীর্ঘ হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামির সাত্তার বলেন, হরতাল-অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব সব ব্যবসাতেই পড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর এই নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ছে। যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা শুধু সম্পদের ক্ষতি নয়। আমি যে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারব, আমার কাছে ক্রেতা আসবে কি আসবে না সেগুলো নিয়েও কিন্তু ব্যবসায়ীরা চিন্তা করছে। উৎপাদন নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তা করছে। আমার ম্যানুফেকচারি ক্যাপাসিটি ফুললি ইউটিলাইজ করতে পারছি কি পারছি না, সেগুলো নিয়ে তারা চিন্তা করছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) তথ্যমতে, হরতাল-অবরোধে দিনে ক্ষতি হচ্ছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, ১০ বছর আগে ঢাকা চেম্বারের এক গবেষণায় দেখা গেছে একদিনের হরতালে তখন আর্থিক ক্ষতি হতো ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে অর্থনীতির আকার ৪ গুণ বেড়েছে। ফলে এ সময়ের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে ক্ষতিও সেই হারেই বাড়বে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ