ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিশোধের সুদ তিনগুণ!

প্রকাশনার সময়: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:২৬

দেশীয় মুদ্রা বা টাকা অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করছে। অর্থনীতিতে চলা নানা অনিশ্চয়তা আরও বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ যে বিনিময় হারে আনা হয়েছে— তার অনেক বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সুদ গুনতে হচ্ছে তিনগুণ! চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কেবল বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদই ৪ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা বা ৩৭৮ মিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করেছে সরকার। যা এক বছর আগে পরিশোধ করা থেকে তিনগুণ।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের পরিশোধিত এই সুদ তিনগুণেরও বেশি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সরকার আগের বছরের একই সময়ে সুদ বাবদ পরিশোধ করেছিল এক হাজার ২৯৭ কোটি টাকা বা প্রায় ১৩৭ মিলিয়ন ডলার।

তবে এর সঙ্গে রয়েছে ইতিবাচক খবরও। আলোচ্য ত্রৈমাসিকে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি সাতগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২.৮৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৪০৫ মিলিয়ন ডলার।

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, কর্ণফুলী টানেলসহ কিছু বড় ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ যাওয়ায় আসল পরিশোধ শুরু হয়েছে। এছাড়া, সরকারের বাজার-ভিত্তিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এর মধ্যে বাজার-ভিত্তিক ঋণে ফ্লোটিং ইন্টারেস্ট রেটও বেড়েছে।

দুই বছর আগেও বাজার-ভিত্তিক ঋণে এসওএফআর (সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) সুদহার ১ শতাংশের কম ছিল, তা এখন ৫ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কেবল সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১৭৬ শতাংশ। এ কারণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপ বেড়েছে।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ডলার হিসাবে সুদ ও আসল মিলিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ৬৫.৫ শতাংশ বেড়েছে। কর্মকর্তারা জানান, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গেল অর্থবছরে বাজেট সহায়তার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল, সে কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ কম গেছে। কিন্তু এবার পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প ঋণ নেয়ার কৌশল নিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরে ৮.৯৭৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশ প্রথম কোয়ার্টারে আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এ কারণে অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৬১০.৫ শতাংশ।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি পেয়েছে জাপানের কাছ থেকে। এখান থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে জাপানের সঙ্গে কোনো ঋণ চুক্তি ছিল না। আগে জাপানের সঙ্গে মূলত ঋণচুক্তি হতো অর্থবছরের শেষের দিকে। কিন্তু এবার জাপানের সঙ্গে অর্থবছরের শুরুর দিকেই ঋণচুক্তি হয়েছে সরকারের।

জাপানের মতোই অবস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি)। গত অর্থবছরের প্রথম কোয়ার্টারে এডিবির সঙ্গে কোনো ঋণ চুক্তি ছিল না। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ সংস্থার সঙ্গে সরকার ৭৯০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি করেছে। জাপান ও এডিবি ছাড়াও সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে সরকার ২১২ মিলিয়ন প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।

এদিকে, উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি বাড়লেও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবে অর্থছাড় বাড়েনি, বরং বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ১.২৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার। প্রথম প্রান্তিকে উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে জাপান। সংস্থাটি প্রথম প্রান্তিকে ছাড় করেছে ৪২৭.৮ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া, এডিবি ২২৫.৬ মিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংক ২১৮.৮৯ মিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়া ছাড় করেছে ২১০.৯২ মিলিয়ন ডলার।

সামপ্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে সরকার বিনিময় হার সামঞ্জস্য করায় টাকার প্রায় ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ডলারপ্রতি টাকার বিনিময় হার ছিল প্রায় ৮৫ টাকা। এরপর থেকেই টাকার দরপতন শুরু হয়। গত দেড় বছর ধরে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। কারণ প্রয়োজন অনুযায়ী রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়েনি, কিন্তু আমদানি বিলসহ বাহ্যিক পেমেন্ট পরিশোধের চাপ ছিল।

এর আগে, স্থানীয় রপ্তানিকারকরা মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কারণ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ তাদের নিজ নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়নের সুবিধা ভোগ করছিল। কিন্তু, বাহ্যিক পেমেন্টের ক্রমবর্ধমান চাপ, মার্কিন ডলার ও অন্যান্য প্রধান মুদ্রার তুলনায় টাকা দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়নের পর বাংলাদেশের রপ্তানি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। রপ্তানিকারকরা ডলারের বিপরীতে টাকার দিক থেকে বেশি রিটার্ন উপভোগ করছেন।

এ ছাড়াও, এটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশি বাজার থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু, গত এক বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে, যা প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি লাভের অনেকটাই খেয়ে ফেলেছে।

রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি কাঁচামাল, পরিবহন ও জ্বালানির দাম প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে, এতে ব্যবসায়িক খরচ ও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তারপরও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের কারণে গত বছরের তুলনায় স্থানীয় মূল্য সংযোজন প্রায় ৭১ শতাংশ বেড়েছে।

এর কারণ হলো উৎপাদনকারীরা আন্তর্জাতিক পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর নির্ধারিত লিড টাইম ধরে রাখতে আমদানির পরিবর্তে আরও সহজলভ্য কাঁচামাল বেছে নিচ্ছেন। ফলে, পোশাক উৎপাদনকারীরা তীব্র ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ও সারা বছর পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানি করা সুতা ও কাপড়ের ওপর তাদের অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাচ্ছেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা অবশ্যই টাকার অবমূল্যায়নের সুবিধা পাচ্ছি, কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়ের কারণে আমরা এ সুবিধা ধরে রাখতে পারছি না।’ তিনি জানান, এখান থেকে সুবিধা ধরে রাখতে না পারার আরেকটি কারণ হলো স্থানীয় কাঁচামাল সরবরাহকারীরাও তাদের পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ভারত ও তুরস্কের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের মুদ্রার উল্লেখযোগ্যভাবে অবমূল্যায়ন করেছে, তারা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে আরও বেশি প্রতিযোগিতা উপভোগ করছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ব্যাংকগুলোর উচ্চসুদ এবং তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আমরা পুরোপুরি এ সুবিধা পাচ্ছি না। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ২৮ শতাংশ দরপতনের অর্থ এই নয় যে, রপ্তানিকারকরা প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২৮ টাকা অতিরিক্ত পাচ্ছেন।

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ