ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্টার্টআপ ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে

প্রকাশনার সময়: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:৫৬

বিশ্বের অর্থনীতি ব্যবস্থাকে এক রকম ভেঙেই দিয়েছে মহামারি করোনা। করোনায় সমস্যায় পড়েছে অর্থনীতির সব খাত। তবে এসবের মধ্যেও আশা জাগাচ্ছে স্টার্টআপ ব্যবসা। এ খাতে ধীরে ধীরে বাড়ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ।

এখানে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ঈর্ষণীয় হারে। মোট বিনিয়োগের প্রায় ৯৮ শতাংশই বিদেশি। বিদেশি বিনিয়োগের হাত ধরে মোট বিনিয়োগও বেড়েছে। ২০২০ সালে স্টার্টআপে বিনিয়োগ হয় ৩৯.১ মিলিয়ন ডলার। যা চলতি বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১১.৬ মিলিয়ন ডলারে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বড় রকম প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে এই স্টার্টআপ ব্যবসা। লাইটক্যাসল পার্টনার্সের গবেষণা বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশি স্টার্টআপে বিনিয়োগ হয়েছে ১১১.৬ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ ১০৯.৪ মিলিয়ন ডলার তথা প্রায় ৯৮ শতাংশই বিনিয়োগ করেছেন। আর বাকি ২.২ মিলিয়ন ডলার এসেছে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। ২০২০ সালে স্টার্টআপে বিনিয়োগ হয় ৩৯.১ মিলিয়ন ডলার।

গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশি স্টার্টআপ ২৭২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে, যা আগের দশকে ছিল ৩৩০ মিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্টে দেশে এসএমইর জন্য ৭৫ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান শপআপ। ‘বি’ সিরিজের অর্থায়ন হিসেবে এটি কোনো একক স্টার্টআপের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ, যার নেতৃত্বে ছিল পিটার থিয়েলের ভালার ভেঞ্চারস।

এছাড়া, পেপারফ্লাই ১১.৮০ মিলিয়ন, ফ্রন্টিয়ার নিউট্রিশন ইনক ৬ মিলিয়ন, প্রভা হেলথ ৫.৬ মিলিয়ন, ট্রাক লাগবে ৩ মিলিয়ন, ডাটাবার্ড ৩ মিলিয়ন, মায়া ২.১৬ মিলিয়ন, অ্যালিস ৫ লাখ, ইন্টেলিজেন্ট মেশিন ৪ লাখ ৭০ হাজার, শাটল ৪ লাখ, আরোগা ২ লাখ, শিখো ১ লাখ এবং আপস্কিল ১ লাখ ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে।

বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক খাত হলো ফিনটেক, রাইড-শেয়ারিং এবং লজিস্টিকস। অন্যদিকে মার্কেট স্যাচুরেশন এবং মুনাফা কমার কারণে আত্মবিশ্বাস কমেছে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে। লাইটকাস্টলের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে চলমান স্টার্টআপের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ২০০। যেখানে প্রতি বছর প্রায় ২০০টি নতুন স্টার্টআপ যুক্ত হয়। এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এ স্টার্টআপগুলো।

প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও লাইটকাস্টল পার্টনার্সের সিনিয়র বিজনেস কনসালট্যান্ট মেহাদ উল হক বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলো গত দশকে ৩শ’ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সংগ্রহ করেছে। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে, সরকার সমর্থিত ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি), স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের সহায়তায় স্থানীয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারী এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ৩৫.৬ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা হয়। তিনি আরো বলেন, মহামারির প্রভাব কিছুটা কমে আসায় স্টার্টআপগুলো আরো বিনিয়োগ বাড়াতে সক্ষম হবে, আশা করি এ বছরের শেষ নাগাদ ১৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।

স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা সাধারণত ক্ষুদ্র সঞ্চয় বা পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে একটি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা সম্প্রসারণ বা দৈনন্দিন কার্যক্রম ভালোভাবে পরিচালনার জন্য প্রাথমিক তহবিল বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্টার্টআপ ইন্টেলিজেন্ট মেশিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ অলি আহাদ বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির ধরন বদলে গেছে। ব্যবসায়ীরা ভিন্ন ভিন্ন পণ্য উৎপাদন করছেন। এতে একটি কোম্পানি বড় হতে বা সব জিনিস উৎপাদনের প্রয়োজন হয় না। যা অংশীদারভিত্তিক অর্থনীতি।

মোহাম্মদ অলি আহাদ মনে করেন, এখন ছোট একটি উদ্যোগ ক্রমেই বড় হচ্ছে। এজন্যই বড় বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে অর্থায়ন করছেন। তিনি বলেন, তহবিল সংগ্রহ করা স্টার্টআপের মূল লক্ষ্য নয়। তহবিলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখন, যখন একটি স্টার্টআপের কার্যক্রম বাড়ানোর করার দরকার হয়। একটি স্টার্টআপ তহবিল তখনই চায়, যখন এটি গ্রাহকদের কাছ থেকে আয় এবং ব্যয়ের সমন্বয় করতে পারে না।

সেই সঙ্গে যখন পরিষেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজন হয় তখন তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করে। বিভিন্ন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেয়া নতুন তহবিল মূলত ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই নেয়া হয়।

পেপারফ্লাইয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান বিপণন কর্মকর্তা রাহাত আহমেদ বলেন, স্মার্ট লজিস্টিক সার্ভিসের মাধ্যমে ডেলিভারি সার্ভিসকে দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ২০১৬ সালে আমরা ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এরপর ই-কমার্স ব্যবসার প্রসারের ফলে ডেলিভারি অর্ডারের পরিমাণ বেড়েছে। যে কারণে আমরা অবকাঠামো এবং ক্ষমতা উন্নত করার পরিকল্পনা করছি। তিনি বলেন, সেবার সক্ষমতা বাড়াতে আমাদের জন্য তহবিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিনিয়োগ পেয়েছি।

ভারতীয় প্রযুক্তি ও কমার্স লজিস্টিক সলিউশন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইকম এক্সপ্রেস থেকে ১১.৮ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পেরেছে পেপারফ্লাই। তিনি আরো বলেন, নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা আমাদের সেবা সম্প্রসারিত করছি। এখন দেশের যে কোনো স্থানে অর্ডার পৌঁছে দিতে পারছি। ব্যবসায় বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে। এর মধ্যে বিনিয়োগকারীরা ব্যবসার ধারণা এবং ব্যবসায়িক সম্ভাবনার দিকটি রয়েছে।

এছাড়াও, তারা ব্যবসা শুরুর পদ্ধতি এবং আইনি দিকগুলোও যাচাই-বাছাই করে।

শাটলের চিফ অপারেটিং অফিসার জাওয়াদ জাহাঙ্গ বলেন, আমরা নিরাপদ পরিবহনে সেবা প্রদানের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য কাজ করছি। শাটল, রাজধানীভিত্তিক স্টার্টআপ যা একটি অ্যাপভিত্তিক রাইড-শেয়ারিং পরিষেবা দিচ্ছে। এটি প্রাথমিক তহবিল পেয়েছে ৪ লাখ ডলার। তিনি বলেন, শুরুর পর্যায়ে ফান্ড সংগ্রহ করা খুবই কঠিন, আমাদের লক্ষ্যই হলো ব্যবসার বিস্তার ঘটানো।

স্টার্টআপের জন্য বৈশ্বিক তহবিল সংগ্রহে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ভারত ও পাকিস্তানের মতো পার্শ্ববর্তী দেশগুলো।

স্টার্টআপ ইন্টেলিজেন্ট মেশিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ অলি আহাদ বলেন, বাংলাদেশে এখনো বিনিয়োগকারীরা উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তার প্রতিভার চেয়ে অর্থকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এজন্য তারা স্টার্টআপের জন্য বিনিয়োগ নিয়ে আসছে না। অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ খুবই দুর্বল। তিনি বলেন, ভেঞ্চার ফান্ড ম্যানেজার এবং স্টার্টআপদের যোগাযোগ আরো বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে বিডিজবস ডটকমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফাহিম মাসরুর বলেন, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সরকারের ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ওপর কর অব্যাহতি দেয়ার পাশাপাশি আইসিটি সেক্টরের কর মওকুফের মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো উচিত। এছাড়া, স্টার্টআপগুলোর তহবিলের বাধা দূর করা উচিত বলেও মনে করে বেসিসের সাবেক এ সভাপতি।

ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইক্যুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ভিসিপিইএবি) চেয়ারম্যান শামীম আহসান বলেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি স্টার্টআপ এবং স্টার্টআপে বিনিয়োগ উভয়ই বেড়েছে। কিন্তু ভারত এবং পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশের তুলনায় আমরা সুযোগটি কাজে লাগাতে অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা যদি স্টার্টআপের জন্য বিনিয়োগ করতে না পারি, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের অর্জিত মুনাফার অধিকাংশই নিয়ে নেবে।

বিকাশের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে শামীম দেশীয় জায়ান্ট কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীদের স্টার্টআপগুলোতে অর্থায়নের আহ্বান জানান। উদ্যোক্তাদের তহবিলের কারণেই সফল স্টার্টআপগুলো আরো সফল হয়। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা তহবিল বিনিয়োগ করার পর স্টার্টআপগুলোকে দেখভালের পাশাপাশি নানারকম পরামর্শও দেয়। আরো বেশি প্রাথমিক তহবিল এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সরকারকে কর অব্যাহতিসহ নানা সুবিধা দেয়া উচিত বলেও মনে করেন ভিসিপিইএবির চেয়ারম্যান শামীম আহসান।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ