ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আতঙ্ক শুক্রবারের ফাঁদ!

প্রকাশনার সময়: ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৪

চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের বাজার করার দিন শুক্রবার। এসব মানুষের কাছে দিনটি যেন আতঙ্কের নাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় অন্যান্য দিনের তুলনায় শুক্রবার দ্রব্যমূল্যের আরও একধাপ তেজ বাড়ে রাজধানীর প্রায় সব বাজারে। বিক্রেতারা বলছেন, শুক্রবার যে কোনো দিনের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকে। মালও বেশি আসে। তাও দাম বাড়ে। ক্রেতারা বলছেন, চাহিদা ঘিরে ব্যবসায়ীরা যেন ফাঁদ পাতে। নেয় নানা কৌশল। এদিন প্রতিটি পণ্যেরই কেজিতে দাম বাড়ে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। যার সত্যতাও মিলেছে গত দুই দিনের বাজারদর পর্যালোচনায়। গতকাল শুক্রবার নিউমার্কেট বনলতা কাঁচা বাজার, নবাবগঞ্জ এবং রাজধানীর বিভিন্ন বাজারসহ হাতিরপুলের অন্তত ১০ জন ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এমন তথ্য।

বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, দামে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এর মধ্যে তুলনামূলক কিছুটা কমে সবজি মিলছে নিউমার্কেট কাঁচা বাজার এবং নবাবগঞ্জ বাজারে। এ দুই বাজারের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে হাতিরপুল বাজারের বিক্রেতাদের।

রাজধানীর বাজারগুলোতে শীতকালীন সবজি লাউ, টমেটো, ফুলকপি, সিম, মুলা ও বরবটি আসতে শুরু করেছে। তবু আগের সেই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এসব সবজি। অধিকাংশ সবজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ফলে বাজারে এসে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ।

মধ্যবাড্ডা বাজার ঘুরে দেখা যায়, শীতকালীন সবজি সিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি। ৪০ থেকে ৫০ টাকার লাউ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা পিস। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি। গাজর বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজিতে। বরবটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। করলা ও বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকা কেজিতে। কচুর লতি ও কচুরমুখী বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে।

শীতকালীন সবজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। পটল, ঝিঙে, ধুন্দল বিক্রি হচ্ছে একই দরে। প্রতিপিস ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, কুমড়া ৬০ টাকা এবং কাঁচামরিচ ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া শসা ও আলু ৬০ টাকা কেজি। আর সবচেয়ে কম দাম পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজিতে।

মধ্যবাড্ডা বাজারে ৫০০ টাকা নিয়ে এসেছেন সত্তোর্ধ্ব ক্রেতা আশিকুল ইসলাম। বাজার করতে এসে সবজির দাম শুনে হতবাক। তিনি চার-পাঁচটি দোকান ঘুরে এক কেজি করে পটল ও আলু, একপোয়া কাঁচামরিচ কিনে বাসায় পথ ধরেন।

বাজারে আসা মধ্যবয়সি ক্রেতা সিরাজুল ইসলাম। দুই দোকান ঘুরে ফুলকপি, লাউ, সিম ও মুলার দর জিজ্ঞেস করেন, দাম না মেলায় এক কেজি ঢেঁড়স কিনলেন ৬০ টাকায়, এর সঙ্গে দোকানদারকে অনুরোধ করলেন যেন ১০ টাকার কাঁচামরিচ দেন। ঢেঁড়স ও কাঁচামরিচ কিনে বাসার পথ ধরলেন তিনিও। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাছ-মাংসের পর ডিমও খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি। এখন সবজি খেয়েও যে জীবন পার করব সেটাও পারছি না। সরকার জিনিসপত্রের দাম কমানোর বিষয় নিয়ে কোনো চেষ্টা করছে না। এখন দেখছি না খেয়েই মরতে হবে।

মধ্যবাড্ডা বাজারে এক ব্যবসায়ী বলেন, এখন সব ধরনের সবজির দামই অনেক বেশি। অন্যান্য বছর এ সময়ে বড় বাজার ভর্তি সবজি থাকে। কিন্তু এখন বাজারে গিয়ে পাওয়া যায় না। আমরা খুচরা বিক্রি করি। যেদিন কম দামে আনি সেদিন কম দামে বিক্রি করি। আমাদের কেনা দাম বেশি থাকায় বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

একই বাজারের আরেক সবজি ব্যবসায়ী তৌহিদ রানা বলেন, শীতের সবজি বাজারে আসতে শুরু করছে, তবে চাহিদার তুলনায় কম আসছে। যখন পুরোদমে সবজি আসা শুরু করবে তখন দাম কমতে শুরু করবে।

গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সবজিখেত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও ঢাকার বাজারগুলোতে সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বাড়তি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা এমন দাবি করলেও বাজারে এমন কোনো সবজি নেই, যা পাওয়া যাচ্ছে না। সরবরাহও প্রচুর। সব বাজারেই এমন চিত্র দেখা গেছে।

পণ্যের দাম বাড়ায় নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের ওপর চাপ আরও বাড়ছে। বাজারের তালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে তাদের। অধিকাংশ মানুষ অস্বাভাবিক বাজারদরে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

মালিবাগ বাজারের রিকশাচালক নান্টু মিয়া বলেন, দামের চোটে আমরা কিছুই কিনতে পারছি না। আগে মাছ-মাংস না খেতে পারলে শাকসবজি খেয়ে থাকতাম। এখন সেটাও সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চললে গরিব মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। সবজি বিক্রেতারা বলছেন, খেতে সবজি পচে নষ্ট হয়েছে। সরবরাহ বিঘ্ন হওয়ায় দাম বেড়েছে। মেরাদিয়া বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে সবজির দাম বেড়েছে। শীতের সবজি নামলে দাম কমে আসবে বলে জানান তিনি।

মেরাদিয়ায় বাজার করতে আসা রফিকুল নামে একজন বলেন, কয়েক মাসে যেসব সবজির দাম বেড়েছে, তা কমার নাম নেই। বরং প্রতিদিন দাম বাড়তেই থাকে। দিন যত এগোচ্ছে, বাজারদর ততই বাড়ছে।

আশিকুর রহমান নামে এক ক্রেতা জানান, ‘আমার বাড়ি গ্রামে। সেখানে এককেজি বেগুন ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে শুনেছি। অথচ ঢাকায় ১২০-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাত বদলেই কেজিতে যদি তিনগুণ দাম বাড়ে তাহলে আমরা বাঁচব কেমনে। বাজারের কথা শুনেই আতঙ্কে উঠি।’

স্বস্তি নেই মাছ-মাংসের বাজারেও। কম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কেনেন পাঙাশ, চাষের কই ও তেলাপিয়া জাতীয় মাছ।

শান্তিনগর বাজারের মাছ বিক্রেতা ইউনুস হোসেন বলেন, এমনিতেই কয়েক সপ্তাহ ধরে মাছের দাম বেশি ছিল। এর মধ্যে ইলিশ ধরা বন্ধ রয়েছে। সরবরাহ কম থাকায় মাছের দাম বেড়েছে।

মুরগির বাজার ঘুরে দেখা যায়, কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লাল কক বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়।

নবাবগঞ্জ বাজারের মুরগি দোকানি রহিম জানান, বৃহস্পতিবার রাতেও ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করেছি ১৯০ টাকায়। আজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা দরে। পুরান মাল নতুন দামে বিক্রি করার কারণ জানতে চাইলে এ বিক্রেতা বলেন, নতুন মালও আসছে। নতুন কেনা দাম বেশি, তাই বিক্রিও বেশি। শুক্রবার তো, আগামীকাল আবারও দাম পড়ে যাবে।

নিউমার্কেট বনলতা মার্কেটের মাছ বিক্রেতা বাবু জানান, দাম বেশি সবসময়ই শুনতে হয় আমাদের। আজকে শুক্রবার (গতকাল) সেটাও তো মাথায় রাখতে হবে। আজকের মাল, একের মাল। শুক্রবারে দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে এই বিক্রেতা বলেন, চাহিদা বেশি, দাম তো বাড়বেই। এদিন সবাই টাকা নিয়েই বাজারে আসে, খালি ব্যাগ নিয়ে কেউই ফেরত যায় না। আমরা বিক্রি করি, সাপ্লাইয়ারা ঠিকমত সাপ্লাই দিলে ‘বাড়তি দাম’ ‘বাড়তি দাম’ আর শুনতে হতো না বলে মত এই বিক্রেতার। নিউমার্কেট বনলতা মার্কেটে সপ্তাহের বাজার করতে আসা মাহমুদুল নামে এক ক্রেতা বলেন, ইচ্ছে থাকলেও সপ্তাহের অন্যদিনে বাজার করার সময় সুযোগ হয় না। বউ কিংবা আমাকে থাকতে হয় অফিসে। শুক্রবার সকালের দিকটাকে বাজারের জন্য ঠিক করে রাখছি। শনিবার পরিবারকে সময় দেই। পরদিন থেকে শুরু হয় আবারও ব্যস্ততা। দাম নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, দাম যা চায় তাই দিতে হয়। আমরা বাধ্য। অপশন নেই। তদারকি না থাকলে যা হয় আর কি।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ