ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্ষতির মুখে ব্যবসা-বাণিজ্য

প্রকাশনার সময়: ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৫০

বৈশ্বিক সুদহার বেড়ে যাওয়া এবং চলতি বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর ২০ শতাংশ কর আরোপ— এতে বিদেশি ঋণগ্রহণ আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ঋণ গ্রহণের এই ব্যয় বেড়ে এখন প্রায় ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে বিদেশি ঋণের ওপর কার্যকর হওয়া এ করের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা।

বিশ্লেষক ও ব্যাংকারদের আভাস, এতে দেশের শিল্প খাতের বিকাশ উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হবে। কারণ, ব্যয়-সাশ্রয়ী এসব ঋণের ওপর বিপুলভাবে নির্ভর করতেন উদ্যোক্তারা।

যেমন দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় টেক্সটাইল ও পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক— ডিবিএল গ্রুপ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যাস করপোরেশন (আইএফসি), ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্টসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন সংস্থা থেকে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিত।

গতবছর এ শিল্পগোষ্ঠী এসব সংস্থা থেকে ৯৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। কিন্তু চলতি বছর আর এ ধরনের ঋণ নেয়ার উৎসাহ নেই তাদের। ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার বলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে আমাদের কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিত করতে হতো। এখন মনে হচ্ছে, এসব নিয়ম ও বিধিমালা মেনে ব্যবসা করায় আমাদের জরিমানা করা হয়েছে।

আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে বিদেশি ঋণ আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা যদি টাকায় ঋণ নিয়েও আমদানি করতে চান, তাহলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে ডলার দিতে হবে। অন্যদিকে, ডলারে ঋণ পাওয়া গেলে— সেখান থেকে সরাসরি আমদানি ব্যয় মেটানো যায়। ফলে ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহের ওপর চাপ কমেছে। নতুন কর নীতির কারণে ডলার ঋণের ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিস্তারিত গবেষণার পর এ ধরনের নীতি নেয়া উচিত। এ বছর সরকার ঘোষণা দিতে পারত— যে আগামী বছর থেকে বিদেশি ঋণের ওপর করারোপ করা হবে। সেটা করলে, ব্যাংক ও ব্যবসাগুলো ঋণ পরিশোধের সময় পেত। এখন হঠাৎ করে করের বোঝা তাদের টানতে হবে। তাছাড়া এ নীতি কার্যকরের আগের নেয়া ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও কর প্রযোজ্য হয়েছে।

যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কর ফাঁকি রোধের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে, তাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়া হতে পারে। অর্থাৎ, ঋণে করারোপের আগে তাদের জানাতে হবে। কিন্তু, অন্যান্য দেশের থেকে ঋণে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে জানান তিনি।

আগে লাইবর সুদহারের ভিত্তিতে হলেও— আন্তর্জাতিক বাজারের সুদহার এখন সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (বা সোফর) ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এছাড়া বৈদেশিক ঋণে অতিরিক্ত সর্বোচ্চ ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার যুক্ত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে করোনা মহামারির সময় শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থাকা সোফর বর্তমানে বেড়ে ৫.৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২২ সালের শুরুর দিকেও যা ১ শতাংশের কম ছিল। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারেও সুদহার বেড়েছে।

ব্যাংকাররা জানান, বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে এক বছর মেয়াদে ২০ লাখ ডলার ঋণ নিলে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার ডলার সুদ গুনতে হবে। তার সঙ্গে করোরোপের কারণে, সুদ পরিশোধের সময় প্রায় ৩৯ লাখ টাকা কর দিতে হবে ব্যবসায়ীদের।

এই কর বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়ার কথা থাকলেও, সাধারণত তারা সেটা ঋণ গ্রহীতার ওপরই চাপিয়ে দেয়। এছাড়া পাঁচ বছর আগে নেয়া ঋণও মোট সুদসহ পরিশোধ করলে নতুন বিধিমালার আওতায় করের অধীনে আসবে।

করারোপের আগে, স্থানীয় ঋণের ৯ শতাংশ সুদহারের তুলনায় বাংলাদেশি একজন গ্রাহককে আন্তর্জাতিক ঋণে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদ দিতে হতো। বর্তমানে, বিদেশ থেকে ডলারে ঋণ নেওয়ার সুদ প্রায় ১১ শতাংশ হারের, যা স্থানীয় ঋণের সুদহার ১০.১০ শতাংশের চেয়েও বেশি।

সতর্ক করে ব্যাংকাররা বলছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এ করারোপ ডলারে ঋণ নেয়াকে নিরুৎসাহিত করবে। কিন্তু তা কমলে দেশের মুদ্রা রিজার্ভও কমে যাবে, যা এখন ২৩.৩ বিলিয়ন ডলারে রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বেসরকারি খাতের নেয়া বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে ১৩.৬৬ বিলিয়ন ডলারই স্বল্পমেয়াদি ঋণ। এবছরে জুনের শেষ পর্যন্ত অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে নেয়া স্বল্পমেয়াদি ঋণের বকেয়া ছিল ২.৯২ বিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্যে অর্থায়নসহ বিদেশি ঋণ আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় দেশের প্রস্তুতকারক খাতও উৎপাদন কমাতে বাধ্য হবে। এতে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়ে, সার্বিকভাবে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড কমে যাবে।

ডিবিএল গ্রুপের এম এ জব্বার বলেন, কম খরচে বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আমরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করছি। বর্তমানে আমরা তিনটি নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপনের কাজ করছি। কিন্তু ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের এসব পরিকল্পনা পেছাতে হচ্ছে।

দেশের সর্ববৃহৎ ইস্পাত উৎপাদক বিএসআরএম গ্রুপ। বিদেশি ঋণে করারোপ নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন। এতে তারা তাদের মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা করছে।

বিএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত গত ১০ জুলাই চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতিকে লেখা একটি চিঠিতে বলেছেন, ‘উচ্চ খরচের কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিদেশি ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হবেন, এতে বৈদেশিক মুদ্রা (বিশেষত ডলার) সংকট আরও তীব্র হবে।’

দেশের একটি শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, এ করারোপের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়বে— যার ধারাবাহিক প্রভাব পড়বে ইতোমধ্যেই উচ্চ অবস্থানে থাকা মূল্যস্ফীতিতে। রপ্তানি আয়ও প্রভাবিত হবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে যেসব পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করা হচ্ছে, তার অনেকগুলোর জন্যই বিদেশি উৎস থেকে আমদানি করতে হতে পারে। কিন্তু এ পরিবর্তনের ফলে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তাছাড়া মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমাতে পারে। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিও থমকে যাবে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, দেড় বছর আগেও এক ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, এখন তা প্রায় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ঋণ পরিশোধের ব্যয় ইতোমধ্যেই প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে নতুন করের কারণে আমাদের আগের নেয়া ঋণ পরিশোধই কঠিন হয়ে পড়বে।

বেসরকারি একটি ব্যাংক এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে, বিদেশি ঋণের সুদে করারোপ ব্যাংকেরও ব্যয় বাড়াবে। ব্যাখ্যা করে চিঠিতে বলা হয়, নগদ বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে স্বল্প-মেয়াদি বিদেশি ঋণ নেয়া। কিন্তু সুদ পরিশোধে কর দিতে হলে এ ঋণ গ্রহণের খরচ বাড়বে। এতে স্বল্পমেয়াদি আমদানি ও রপ্তানির বিলে ডিসকাউন্ট, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নসহ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কগুলোয় আর্থিক সমর্থন দিতে তাদের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের লেনদেনে প্রভাব পড়বে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, করারোপের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য দেশের শিল্প-পর্যায়ের গ্রাহকদের বায়ার্স ক্রেডিটে ঋণ প্রদানকে কমাবে। এছাড়া ঋণপত্র (এলসি) কনফার্মেশনের চার্জ ও বাণিজ্য অর্থায়নের খরচও বাড়বে।

এই কর দেশিয় ব্যাংকের বিদেশি উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার সক্ষমতা হ্রাস করবে। এতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আরও চরম হবে, স্থানীয় ব্যাংকগুলোর তহবিলের খরচও বাড়বে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির সামনে বড় প্রতিকূলতা তৈরি হবে। এছাড়া বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের ব্যাংকগুলোর অনুকূল শর্তে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে দরকষাকষির সক্ষমতা ব্যাহত হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ