ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রপ্তানি কমেছে উন্নত দেশে

প্রকাশনার সময়: ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০৭:০৬

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা এখনও কাটেনি। ধুঁকছে বিশ্ব অর্থনীতি। যার প্রভাব পড়েছে দেশের পণ্য রপ্তানিতেও। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি কমেছে। পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রেই ৭ শতাংশ কমেছে। যা বড় চিন্তার কারণ। তবে এ অচলাবস্থা দ্রুতই কেটে যাবে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

এদিকে অপ্রচলিত পণ্যে প্রবৃদ্ধি এখনও নেতিবাচক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমেরিকার অর্থনীতি চাপে আছে। এ কারণে সেখানে মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে রপ্তানি বাড়েনি। এছাড়া করোনার পর চায়না আমদানি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তাদের নিজেদের বাজার সম্প্রসারণ করছে। তবে ভবিষ্যতে এ সমস্যা আর থাকবে না বলে জানান তারা।

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি কমেছে। পণ্য রপ্তানির বিপরীতে উপার্জিত অর্থের সিংহভাগই আসে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের ১৫টি দেশ থেকে। এর মধ্যে এক বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলারের বেশি আসে ১২টি দেশ থেকে।

এই দেশগুলো হলো— যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, ভারত, জাপান, পোল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। এ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও পোল্যান্ডে রপ্তানি কমেছে। আমেরিকা-ইউরোপের বাইরে রপ্তানি কমেছে চীন ও রাশিয়ায়ও।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট পাঁচ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। শীর্ষ ১২ দেশে হয়েছে চার হাজার ২০৪ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বাজারগুলোতে রপ্তানি হয়েছিল চার হাজার ১১ কোটি ডলারের পণ্য। এসব দেশে এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে ১৯৩ কোটি ডলারের বেশি।

তবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ড যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ ও ১৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

দেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে মোট রপ্তানির ৮৮ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো আমেরিকার বাজারে রপ্তানি ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে গত অর্থবছরে রপ্তানি কমে ৯৭০ কোটি ডলারে নেমেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশের মতো কম।

ইউরোপের দেশ জার্মানিকে বলা হয় বাংলাদেশি পণ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বড় বাজার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটিতে ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বাজারে রপ্তানি হয় ৭৫৯ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২৩ অর্থবছরে জার্মানিতে মোট রপ্তানির ৯৪ শতাংশ ছিল তৈরি পোশাক। যার মূল্যমান প্রায় ৬৬৮ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি হয় হোম টেক্সটাইল পণ্য।

২০২২-২৩ অর্থবছরে চীনে ৬৭৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা তার আগের বছরের তুলায় ০ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটিতে ৬৮৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরে দেশটিতে ২৮৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, ৭ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল ও ১১ কোটি ডলারের প্লাস্টিক রপ্তানি হয়।

ইউরোপ যুদ্ধের প্রভাবে রাশিয়া ও পোল্যান্ডেও রপ্তানি কমেছে। পোল্যান্ডে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাশিয়ায় ৪৬০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দেশটিতে রপ্তানি করা প্রধান প্রধান পণ্য নিটওয়্যার। আলোচ্য সময়ে দেশটিতে ৪২৫ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন দেশের উদ্যোক্তারা।

যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট রপ্তানি আয় ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ কম। তবে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বের হয়ে গেলেও দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমেনি। গত অর্থবছর দেশটিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা এর আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে অর্থাৎ, ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয় ৪৮২ কোটি ডলারের পণ্য। বাজারটিতে শীর্ষ তিন রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক ৫০৩ কোটি ডলার, হোম টেক্সটাইল ৮ কোটি ডলার এবং হিমায়িত চিংড়ি ৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। স্পেনে মোট রপ্তানির ৯৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। ফ্রান্সের বাজারে ৩২৯ কোটি ডলার রপ্তানির বিপরীতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ শতাংশ। ইতালিতে ২৩৯ কোটি ও নেদারল্যান্ডস ২০৯ কোটি ডলারের পণ্য নিয়েছে। যার মধ্যে ইতালিতে ৪০ ও নেদারল্যান্ডসে পৌনে ১৮ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে মোট রপ্তানির ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক। প্রধান প্রধান পণ্যভিত্তিক রপ্তানি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আটটি পণ্য থেকে মোট রপ্তানি আয়ের ৯৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। পণ্যগুলো হলো— ওভেন পোশাক, নিটওয়্যার (৬১), হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চামড়া-চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা এবং প্রকৌশল দ্রব্যাদি। এসব পণ্য রপ্তানি করে এসেছে পাঁচ হাজার ২০৭ কোটি ডলার।

জানতে চাইলে ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান বলেন, চায়না ও রাশিয়া আমাদের জন্য নতুন বাজার। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ইইউ আমাদের প্রধান বাজার। আমেরিকার অর্থনীতি চাপে আছে। ফিসক্যাল পলিসির কারণে সেখানে ইন্টারেস্ট রেট অনেক হাই। এ কারণে সেখানে মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছে। ওদের কেনা কমায় আমাদের রপ্তানি বাড়েনি।

নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে স্পেশাল টেক্সটাইল, শাকসবজি, পেট্রোলিয়াম বাই প্রোডাক্টস, ওষুধ, ফলমূল, হ্যান্ডিক্রাফটস, ফার্নিচার, কার্পেট, চিংড়ি মাছ, রাবার, নিট ফেব্রিকস, বাইসাইকেল, কপার ওয়্যার, প্রকৌশলী যন্ত্রাংশ, শুকনো খাবার, জুট ইয়ার্ন অ্যান্ড টোয়াইন, ক্র্যাবস, টেরি টাওয়েলস, হোম টেক্সটাইল, কাঁচা পাট, কেমিক্যাল প্রোডাক্টস, জুট সকস্ অ্যান্ড ব্যাগ, চামড়ার জুতা, চামড়া, গলফ সাফট ইত্যাদি পণ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।’

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে চার হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। যার মধ্যে নিট পোশাক দুই হাজার ৩২১ কোটি ডলারের ও ওভেন পোশাক দুই হাজার ১২৫ কোটি ডলারের। এই রপ্তানি ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। আলোচ্য সময়ে ২০৯ কোটি ডলারের প্লাস্টিক-মেলামাইন দ্রব্যাদি রপ্তানি হয়েছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। এছাড়া হোম টেক্সটাইলে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, চামড়াজাত পণ্যে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছে ২৬ দশমিক ২৬ শতাংশ, কৃষিজাত পণ্যে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ওষুধে ৭ শতাংশ, কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্যে ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ, বাইসাইকেল ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ, প্রকৌশল দ্রব্যাদিতে ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। পোশাক খাতসহ প্রবৃদ্ধি হওয়া এসব খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ, কর হার, বন্দর খালাস সুবিধা দেয়া হয়।

এছাড়া ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও ভর্তুকিও দেয়া হয়। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যে কমপ্লায়েন্স ইস্যু রয়েছে। সেখানে কঠিন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও হাইজিনের ব্যাপার থাকে। এ কারণে এসব পণ্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের না হলে রপ্তানিতে সমস্যা হয়। আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশনের কোনো উদ্যোগ বা রোডম্যাপও নেয়া হয়নি। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এর প্রধান কাঁচামাল আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। একই কথা চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও।

এসব পণ্যের গুণগত মান ঠিক করতে পারলে আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি আরও সমৃদ্ধ হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রপ্তানি আয় বাড়াতে অপ্রচলিত বাজারে পণ্য বিস্তারের বিকল্প নেই। ভারত-অস্ট্রেলিয়াকে অপ্রচলিত বাজার বলার সুযোগ কম। কেননা এ বাজারগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ভালো করছি। অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য নন ট্র্যাডিশনাল মার্কেট হচ্ছে চায়না। মধ্যপ্রাচ্য ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে অন্যান্য দেশ ভালো করছে। রপ্তানিতে এগোতে হলে এ বাজারগুলো আমাদের ধরতে হবে।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ