ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বাড়ছে লোকসান

প্রকাশনার সময়: ২৫ জুলাই ২০২৩, ০৭:১৭

মূল্যস্ফীতির চাপে পুরো বিশ্ব। পুড়ছে পোশাকের বড় বাজার ইউরোপও। ফলে সেখান থেকে কমে আসছে রপ্তানি কার্যাদেশ। অন্তত ২০ শতাংশ নিম্ন সক্ষমতায় কারখানা চালাতে হচ্ছে পোশাক রপ্তানিকারকদের। তার সঙ্গে দেশে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে শুরু করলে— রপ্তানি কার্যাদেশ বৃদ্ধির আশা করেছিলেন রপ্তানিকারকরা। কিন্তু দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এখন ব্যবসার জন্য নতুন হুমকি হয়ে উঠেছে।

এতে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতাই সময়মতো তাদের পণ্যের চালান পাওয়ার বিষয়ে সংশয়ী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সার্বিক অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন শঙ্কার কথাই জানান তারা।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে— এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত না হতে আমরা দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি একান্ত অনুরোধ জানাই।’

এমন উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের কথাতেও। তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার সুবাদেই রপ্তানি ও অর্থনীতি বিকশিত হতে পেরেছে।

তিনি বলেন, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সময় পোশাক রপ্তানিকারকদের কাছে কার্যাদেশ আসা কমে যায়। পাশাপাশি, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধও তাদের ব্যবসাকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় যদি দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বায়াররা শঙ্কিত হবে, যা আমাদের ব্যবসার পক্ষে মোটেও অনুকূল হবে না।

চলমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এ ধরনের আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারবেন না পোশাক রপ্তানিকারকরা। রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো না থাকলে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তথা ব্যবসা, বাণিজ্যও তার ভুক্তভোগী হবে।

বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬.৬৭ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেশের রপ্তানি পৌঁছায় ৫৫.৫৫ বিলিয়ন ডলারে। এর পেছনে মূল অবদান ছিল পোশাক খাতের শক্তিশালী পারফর্ম্যান্সের।

মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। কিন্তু বৈশ্বিক চাহিদার মন্দা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক সংকট এবং পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোতে মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে রপ্তানি আয় ৫৮ বিলিয়ন ডলারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪.২৮ শতাংশ কম হয়েছিল।

রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে এম শহিদ রেজা জানান, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে তিনি অর্ডার বাড়বে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক বায়ার ধীরে সুস্থে অর্ডার দিচ্ছে। তিনি বলেন, কয়েক মাস চেষ্টার পর সম্প্রতি আমরা এক কাস্টমারের থেকে অনুমোদন পাই। কিন্তু সেই কাস্টমার এখন আমাদের অপেক্ষা করতে বলছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কোরিয়ার একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের প্রচেষ্টাও স্থবির হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। নাম না প্রকাশের শর্তে দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি টেক্সটাইল (বস্ত্র) উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে এ শিল্পের অধিকাংশ ফ্যাক্টরি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে বেশিরভাগ টেক্সটাইল মিল মালিকরা পুঁজি সংকটে রয়েছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।

ইউটিলিটি পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও ব্যবসায় গতি না থাকায় পুঁজি সংকটের মতো নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেন রপ্তানিকারকরা। একজন রপ্তানিকারক জানান, প্রায় ৪ মাস আগেই জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দিতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বায়ার তাকে সতর্ক করেছিলেন।

এ কারণে তারা সতর্কভাবে অর্ডার দিচ্ছেন। সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্ডার দেয়ার বিষয়ে পশ্চিমা ক্রেতারা বেশি সতর্ক থাকে বলেও জানান তিনি। বিএনপি বর্তমান সরকারের পতন ও নির্দলীয় নির্বাচন-কালীন সরকার প্রতিষ্ঠার একদফা দাবি ঘোষণার পর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে।

এপর্যায়ে উভয় দলের পক্ষ থেকেই পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও মিছিলের ধারাবাহিকতা শুরু হয়। এমতাবস্থায়, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে সার্বিক অর্থনীতির অবস্থার সম্পর্ক তুলে ধরে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো না থাকলে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তথা ব্যবসা, বাণিজ্যও তার ভুক্তভোগী হবে।

তিনি বলেন, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক রূপান্তর ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি না নেয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের পুরোনো কৌশলের আঘাত সইতে পারবে না। অর্থনীতি ও ব্যবসার সমৃদ্ধি, বিকাশের জন্য আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই।

নাম না প্রকাশের শর্তে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক বায়িং হাউজের হেড অব বিজনেস বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে, গোলযোগের আশঙ্কা থেকে অনেক বায়ার নিজেদের সরবরাহ চক্রকে সুরক্ষিত রাখতে ভারতমুখী হচ্ছে।

সব বায়ার-ই একটি স্থিতিশীল দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে চান। কিছু ব্যক্তি-বিশেষের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতিও তাদের আরও সতর্ক হতে বাধ্য করেছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা অনুসরণ করে— সে কথাও উল্লেখ করেন তিনি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরাও।

সব দলের প্রতি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দলীয় কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ পালনের আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, নাহলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়ে পতন হবে রপ্তানি আয়ের। গবেষণা প্রতিষ্ঠান— সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্থানীয় ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার প্রভাব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পড়ায় দেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। একই সঙ্গে, সব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ