ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঋণদানে নাম বাংলাদেশের

প্রকাশনার সময়: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৫:৪৭

ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ে নাম লেখাল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে কোনো দেশকে ঋণ দিয়ে নতুন এক পথের উন্মোচন করল। দেশের নানা প্রয়োজন মিটিয়ে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাকে দুই দফা ১০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার মাধ্যমে ঋণদাতা দেশের তালিকায় নাম লেখাল বাংলাদেশ। মোট ২৫ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে মোট ১০ কোটি ডলার ছাড় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ঋণ দেয়ার মাধ্যমে প্রথম কোনো দেশকে ঋণ দিল বাংলাদেশ।

এই অর্থের পরিমাণ (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা) ৪২৫ কোটি টাকা। গত এক যুগে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রফতানিতে ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধিতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীত হওয়ায় ঋণ দেয়ার এই সক্ষমতা অর্জন করল বাংলাদেশ। এই বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর শ্রীলঙ্কাকে দেয়া হবে মোট ২৫ কোটি ডলার। ৫ কিস্তিতে এই অর্থ ছাড় করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এ অর্থ দেয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অনুকূলে অর্থ ছাড়ের পর রিজার্ভ দাঁড়ায় ৪৬ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৬৫৮ কোটি ডলার।

গত মে মাসে মুদ্রা বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) আওতায় শ্রীলঙ্কাকে এই ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার চাহিদার ভিত্তিতে প্রথম দফায় ৫০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ডলার ছাড় করা হয়েছে। প্রতিশ্রুত ঋণের বাকি অংশ দেশটির চাহিদা বিবেচনায় ছাড় করা হবে।’

শ্রীলঙ্কার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তাদের ঋণ দেয়ার নীতিগত অনুমোদন হয়। এরপর চুক্তিনামা তৈরিসহ কিছু প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগল।

দেশের মধ্যেও এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের সঙ্গে সোয়াপ করে। সাধারণভাবে টাকা ও ডলারের সোয়াপ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার সাময়িক সংকটে পড়লে টাকা রেখে স্বল্প সময়ের জন্য ডলার নেয়। ওই ব্যাংকের হাতে ডলার এলে নির্ধারিত সুদসহ আবার তা পরিশোধ করতে হয়। তখন

জমা টাকা ফেরত পায় ব্যাংকটি। যে সব দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কম তারা বিপদে পড়লে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। তবে শ্রীলঙ্কার এই মুহূর্তে সেটি নেই।

জানতে চাইলে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এভাবে ডলার দিচ্ছে। যে পরিমাণ ডলার বাংলাদেশ দেবে সেটা রিজার্ভ থেকে কমে যাবে। এতে বাংলাদেশের সুনাম হবে। তবে কোনো কোনো সময় এ ধরনের টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হয়, তখন একটু অসুবিধা হয়।’

কারেন্সি সোয়াপ বা আন্তঃদেশীয় মুদ্রা বিনিময় অনেকটা ‘ব্যাংক টু ব্যাংক লেন্ডিং’- এর মতো হওয়ায় ঝুঁকি কম বলে জানান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর। তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা যদি এই টাকা দিতে না পারে, তখন বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে যে বৈদেশিক বাণিজ্য হয়, সেখানে দেনা-পাওনা থেকে এই টাকা সমন্বয় করে নেয়া যাবে।’

এতে বাংলাদেশের কী লাভ হবে জানতে চাইলে আহসান মনসুর বলেন, ‘এই ঋণ দেয়ায় বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনার পাশাপাশি কান্ট্রি রেটিংয়েও সুবিধা দেবে। তখন বাংলাদেশের রেটিং বেড়ে যাবে আবার শ্রীলঙ্কা রেটিং কমে যাবে।’

বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নে (ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ) চাহিদার তুলনায় অনেক ঘাটতিতে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির জিডিপির আকার ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। কিন্তু বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ৪০০ কোটি ডলারের ঘরে, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশে এ সঞ্চয়ন জিডিপির ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

সমঝোতা অনুযায়ী এই ধারের জন্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে লাইবরের (লন্ডন আন্তঃব্যাংক সুদের হার) সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ সুদ যুক্ত করে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করবে।

তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য দিতে হবে লাইবরের সঙ্গে অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ সুদ। লাইবর হলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফার রেট। বর্তমানে লাইবর রেট ২ শতাংশের কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিয়োগের বিপরীতে গ্যারান্টি দেবে শ্রীলঙ্কার সরকার ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ২৫ কোটি ডলার সমমূল্যের শ্রীলঙ্কান রুপি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লিয়েন হিসেবে জমা থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে রফতানি করা পণ্যের মূল্য স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করবে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত মার্চে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরও ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময়ে তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী রাজি হওয়ার পরে শ্রীলঙ্কার সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠায়।

শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ-সংকটে ভুগছে। বর্তমানে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে তাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। রিজার্ভকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রাখতে হয়।

বাংলাদেশ ২০০১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়লে দেশের রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। তখন বাংলাদেশ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। তখন আকুর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রথম সোয়াপ করে। আকুর সদস্যদেশগুলো বাকিতে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালায়। প্রতি দুই মাস পরপর দেনা-পাওনা সমন্বয় করে। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে কমপক্ষে ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৩৬ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের রিজার্ভ। আর পাকিস্তানের রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার। নেপালের রিজার্ভ উন্নীত হয়েছিল ১১ বিলিয়ন ডলারে। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০১৮ সালের এপ্রিলে। সে সময় দেশটির রিজার্ভ ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার। তবে করোনাকালে সেটি প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ