ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্ষুদ্রঋণ : উত্তরণকালের চ্যালেঞ্জ

প্রকাশনার সময়: ২৪ আগস্ট ২০২১, ০৮:৫১

চার দশক ধরে অন্তঃসলীলা নদীর মতো অর্থনীতিতে প্রবাহমান ধারায় বয়ে চলছে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক বিরোধিতা আর ভিন্নমতাবলম্বীদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাচ্ছে এই খাত। ক্ষুদ্রঋণের মাতৃভূমিতে এখন তৈরি হচ্ছে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ।

তহবিল জোগানোর উৎসপথে তৈরি হয়েছে অদৃশ্য বাধা। আর ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার আয়ে সরকারের ভাগ বাড়ানোর প্রবণতা এখন এগিয়ে যাওয়ার পথে নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। সামাজিক বনাম বাণিজ্যিক পুঁজির দ্বান্দ্বিক অবস্থান বিশ্ব পরিসরে বড় মাত্রার পর্যালোচনার বিষয় হলেও, স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে মিশ্র প্রবণতা।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বিশ্ব পরিসরে সমাদৃত। এখানকার গ্রামীণ ব্যাংক ধারণার প্রতিচ্ছবিতে তৈরি হয়েছে দেশে দেশে প্রতিষ্ঠান। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণের কারণে বিশ্বখ্যাত ফরাসি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়েছেন। ২০১১ সালের ২৫ এপ্রিল তদানীন্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজির বিশেষ দূত মার্টিন ইরশ ঢাকা সফরকালে এমন মন্তব্যও করেছিলেন। বিভিন্ন দেশে পর্যালোচনা করা হয়, বাংলাদেশের অনুসরণীয় নীতি।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি সনদ ফি’র পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের অর্জিত সার্ভিস চার্জ আয়ের ওপর দশমিক ১৫ শতাংশ হারে বাৎসরিক ফি ধার্য করেছে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে এই খাতের কর্ণধারদের অনেক বিষয় এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। উপনিবেশিক ধ্যান-ধারণার মতে, বড় পরিসরে আলোচনা না করেই চাপিয়ে দেয়া হলো বাড়তি ফি। এতে অবশ্য বছর শেষে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, সরকারের অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এমআরএ।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ক্ষুদ্রঋণ খাতের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমিটি ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে বিধিমালা ও আইন সংশোধন বিষয়ে একমতে পৌঁছায়। কিন্ত তা এখনো ফাইলবন্দি। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে শর্ত মুক্ত করার লড়াই এখনো চলছে। এতে অনেক সময় গতি আসে। আবার কখনো কখনো চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ ফি আদায় ছাড়াও সার্ভিস চার্জ আয়ের ওপর দশমিক ১৫ শতাংশ হারে বাৎসরিক ফি আরোপের ফলে মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্বেচ্ছা ও মেয়াদি আমানত উদ্বৃত্তের হার দ্বিগুণ করার প্রস্তাবের সম্মানজনক নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বর্তমানে মোট সঞ্চয় মোট ঋণ স্থিতির ৮০ শতাংশের বেশি হবে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চায় প্রতিষ্ঠানগুলো। মোট সঞ্চয়ের ওপর আরোপিত এ শর্তটি বাতিল হলে সদস্যদের যে কোনো পরিমাণ সঞ্চয় সেবা প্রদান করা যাবে। ক্রমপুঞ্জিভূত উদ্বৃত্তের ৩৫ শতাংশ স্থায়ী সম্পদ অর্জনে এমআরএর পূর্বানুমোদনের শর্ত প্রত্যাহার হলে, অনেকটা পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে। ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচনের একমাত্র হাতিয়ার নয়, তবে সমাজে অনেক পরিবর্তন এনেছে। নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ফেরত দিচ্ছেন না প্রভাবশালীরা। তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কিন্তু দরিদ্র মানুষ, যারা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন, তাদের ভাগ্যে মিলছে না বিদ্যমান ব্যাংকিং সুবিধা।

ক্ষুদ্রঋণ হলো গরিব মানুষের দারিদ্র্যসীমার ওপরে ওঠার ন্যূনতম সুবিধা। এটা ধাপে ধাপে পার হতে হয়। ক্ষুদ্রঋণ প্রচলনের আগে দরিদ্রদের জন্য আর্থিকসেবা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। বহু মডেল হয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থা একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এতদিন আলোচনায় ছিল, ক্ষুদ্রঋণ কতটা দারিদ্র্য দূর করতে পারল।

এতে সরকারের দায়িত্ব কিছুটা দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তাই সরকার ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করা দরকার। মহাজনি ব্যবসার বিকল্প হিসেবে ক্ষুদ্রঋণসুবিধা এসেছে। এটি দরিদ্র মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস। দারিদ্র্যবিমোচন কেন হলো না- একই অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধেও উঠতে পারে। তবে ক্ষুদ্রঋণের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি এর উদ্দেশ্যকে কিছুটা ব্যাহত করছে। এর সেবামাশুল সহনীয় পর্যায়ে আনা দরকার। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়াতে হবে।

পরিচালকদের বিলাসবহুল গাড়ি, বিদেশে ঘোরাঘুরিসহ ঋণ তহবিলের উচ্চ ব্যয় মেটাতে গিয়ে সেবা মাশুল বেড়ে যায়। কিছু দেশে স্টক মার্কেট থেকে টাকা নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ দেয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ অনেক দেশে লোভনীয় ব্যবসায় রূপ নিচ্ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখন ক্ষুদ্রঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে। এ নিয়ে বড় দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে সামাজিক ও বাণিজ্যিক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে। সামাজিক পুঁজির ভেতরে তৈরি হচ্ছে মুনাফামুখি প্রবণতা।

ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের ৮ শতাংশ এখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তারা অল্প পুঁজির ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। মজুরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থায় উত্তরণ পর্ব চলছে। গ্রাহক একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে চার-পাঁচজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন।

এভাবে এই খাত থেকে পল্লী অঞ্চলে ২০ শতাংশ শ্রমশক্তি যোগ হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ এখন ব্যবসায় বিনিয়োগ হিসেবেও দেয়া হচ্ছে। এটি ক্ষুদ্রঋণকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করছে। ক্ষুদ্রঋণ মডেলে একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে।

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে গিয়ে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় কোনো গরিব মানুষ, সে জন্য একটি আইন থাকা দরকার। ঋণখেলাপি বড়লোক হলে তাদের রক্ষার জন্য ‘দেউলিয়া আইন’ আছে। কিন্তু গরিবের জন্য সে রকম আইন নেই। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ খেলাপি হলে এর দায় চাপিয়ে দেয়া হয় ক্ষুদ্রঋণের ওপর।

তবে তহবিল প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত-অপ্রত্যাশিত বাধার প্রাচীর তৈরি করেছে ব্যাংকিং খাত, অদক্ষতা আর নানা চাপে পরিচালিত বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংকট তৈরি হয়েছে। যার খেসারত দিতে হবে তৃণমূলের সাধারণ মানুষকে। যাদের কণ্ঠস্বর সাধারণত নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায় না। তহবিল সংকটে পড়ছে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম।

২৬ শতাংশ বেড়ে ২০১৬ সালে এ সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা প্রায় সাড়ে ৩৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত আয়, যা মোট তহবিলের সাড়ে ৩৩ শতাংশ। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফও তহবিল জোগান দিয়ে থাকে। তবে সেখানে যেন টান চলছে। অথচ স্বায়ত্তশাসিত এ প্রতিষ্ঠানটি এখন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারত।

মোট তহবিলে পিকেএসএফের অবদান ২০১৬ সালের তুলনায় হ্রাস পেয়ে পরের বছর দাঁড়িয়েছে সোয়া আট শতাংশ। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অবদান বাড়লেও এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৫ সালে তা ১৭ শতাংশ থেকে উন্নীত হয়ে ২০১৬ সালে হয়েছে ১৯ শতাংশের কিছুটা বেশি।

সময় ও চাহিদামতো গ্রাহককে তহবিল বিতরণ ও সঠিকভাবে তা আদায় করাই ক্ষুদ্রঋণের মূল চালিকাশক্তি। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঐকান্তিক চেষ্টা, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গ্রাহকের সঙ্গে পারস্পারিক আস্থার সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আদায়ের হার ৯৯ শতাংশের বেশি। প্রায় চার দশক ধরে ক্ষুদ্রঋণের সব ধারাবাহিক অগ্রগতির ফলে দেশের জিডিপিতে এর অবদান ৭ শতাংশ। দারিদ্র্যবিমোচনে প্রত্যক্ষ অবদান ১৪ শতাংশ। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তৃণমূলে মজুরিভিত্তিক ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে ক্ষুদ্রঋণ খাত।

ক্ষুদ্রঋণের উদ্যোক্তারা তহবিল চাহিদা মেটাতে এখন বিদেশি নির্ভরতা বাড়াতে চায়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিদেশি সংস্থারও আগ্রহ আছে। দাতা-গ্রহীতার আগ্রহ থাকলেও, এ নিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া যায়নি। এ বিষয়ে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সক্ষমতার সংকট। বাংলাদেশ মূলত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ পাইয়ে দিতে অনেকাংশে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে।

আইনি কাঠামোর আওতায় থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাকেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে এমন উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্তত পাইলট প্রকল্প হিসাবে, বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র আকারের ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করতে পারে। এরপর প্রায়োগিক সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় তৈরি হতে পারে এ ধরনের নীতি কাঠামো। গতিশীল নেতৃত্ব আরো একধাপ এগিয়ে নিতে পারে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম।

বাংলাদেশে সমহারে ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠানগুলো সমহারে বিকশিত হয়নি। সম্পদ ও কার্যক্রম বিবেচনা নিলে শীর্ষ ১০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাজারের অংশীদারিত্ব প্রায় ৮৫ ভাগ। ৭০টি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব ৯৯ ভাগ। মাত্র এক ভাগ বাজার অংশীদারিত্ব প্রায় ছয়শ’ প্রতিষ্ঠানের কাছে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বাড়তে পারে তাদের কর্মপরিধি। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই গবেষণামূলক কার্যক্রম এড়িয়ে চলছে। সমাজের অন্যসব প্রতিষ্ঠানের মতো এখানেও চলতি হাওয়ায় পথ চলার আগ্রহ বেশি।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ