অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। আড়াই বছরের করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চাপে পড়া অর্থনীতিকে সামাল দিতে কম সুদের বিশাল অঙ্কের এই ঋণ বেশ অবদান রেখেছিল। কিন্তু সেই জোয়ার আর নেই। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম উৎস বিদেশি ঋণপ্রবাহে ভাটা পড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ২৪৬ কোটি ২৫ লাখ (২.৪৬ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। যা অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০.৩০ শতাংশ কম। গত বছরের এই পাঁচ মাসে ৩০৮ কোটি ৯৫ লাখ (৩.০৯ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপে পড়েছে। অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর পাশাপাশি রিজার্ভও কমছে; নেমে এসেছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে। এই চাপ সামাল দিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখন কম সুদের বিদেশি ঋণ-সহায়তা। কিন্তু তেমনটি না হয়ে উল্টো কমছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বিদেশি ঋণপ্রবাহের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশি ঋণপ্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছর। প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ-সহায়তা এসেছিল, যা ছিল গত জুলাইয়ের চেয়ে ৪৮.৫০ শতাংশ বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসে হোঁচট খায়। ওই মাসে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করে দাতারা, যা ছিল আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম।
পরের দুই মাস সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে অবশ্য কিছুটা বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে আসে ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। আর সব শেষ অক্টোবরে এসেছে ৬২ কোটি ১৪ লাখ ডলার। সবশেষ নভেম্বর মাসে তা কমে ৪৯ কোটি ডলারে নেমেছে। সব মিলিয়ে পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০.৩ শতাংশ বিদেশি ঋণ কম এসেছে দেশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতির বিশ্লেষক আতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের রিজার্ভ চাপের মধ্যে আছে। এই চাপ সামলাতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার ঋণ প্রয়োজন। এসব সংস্থার পাইপলাইনে যেসব ঋণ আছে, সেগুলো দ্রুত আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। সুখের খবর হচ্ছে, আইএমএফ ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্যরাও আশ্বাস দিয়েছে। এসব ঋণ যত দ্রুত পাওয়া যাবে, ততই মঙ্গল। তাতে সরকার সহজেই সংকট মোকাবিলা করতে পারবে। আমার বিশ্বাস, ২০২৩ সাল থেকেই সরকার সাহস সঞ্চার করে ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থনীতিও আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।’
অর্থনীতির আরেক গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বৈশ্বিক কারণে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। এ চাপ সামলাতে এই মুহূর্তে কম সুদের বেশি বেশি বিদেশি ঋণের খুব দরকার ছিল। কিন্তু উল্টো কমে যাচ্ছে। সরকারকে চাপমুক্ত হতে বেগ পেতে হচ্ছে। যুদ্ধের ধাক্কা সামাল দিতে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশকে দাতাদের সহায়তা করতে হচ্ছে। সে কারণে এবার ঋণটা একটু কম আসছে। তবে ফেব্রুয়ারিতে যদি আমরা আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তিটা পেয়ে যাই, তাহলে কিন্তু আমাদের সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। রিজার্ভ কমার যে ধারা রয়েছে, সেটা আর থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারি করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গত অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণ-সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো আর কোভিডের ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশকে ঋণ নিতে হচ্ছে দাতা সংস্থাগুলোকে। সে কারণেই বিদেশি ঋণ কমছে। আমার মনে হচ্ছে, এবার গতবারের চেয়ে ঋণ বেশ খানিকটা কম আসবে।
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-নভেম্বর সময়ে দাতাদের কাছ থেকে যে ২৪৬ কোটি ২৫ লাখ ডলারের ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য এসেছে ২৩৫ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। আর অনুদান পাওয়া গেছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে প্রকল্প সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ৩০১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। অনুদান এসেছিল ৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণ-সহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে জাপান, ৭৪ কোটি ২৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে মোট বিদেশি ঋণের ৩০.১৬ শতাংশই দিয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।
চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৪৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) দিয়েছে ২৪ কোটি ৭ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ৪২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। ভারত দিয়েছে ১৪ কোটি ৯১ লাখ ডলার। এ ছাড়া রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া গেছে প্রায় ২০ কোটি ডলার। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ১০ হাজার ডলার।
ইআরডির তথ্য বলছে, জুলাই-নভেম্বর সময়ে দাতাদের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি তলানিতে নেমে এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ৩৯৩ কোটি ৩৬ লাখ ডলার ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। এই বছরের জুলাই-নভেম্বরে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মাত্র ৪৬ কোটি ১৩ লাখ ১০ হাজার ডলারের। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এই বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ৮ গুণের বেশি প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল।
জুলাই-নভেম্বর সময়ে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ৮৮ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার পরিশোধ করেছে সরকার। গত বছরের একই সময়ে সুদ-আসল বাবদ ৮৬ কোটি ৮২ লাখ ৫০ হাজার ডলার শোধ করা হয়েছিল। এ হিসাবে এই পাঁচ মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ১.৪০ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সরকারকে।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ