ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সরকারের ব্যাংকঋণ দ্বিগুণ

প্রকাশনার সময়: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:২২

ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ ক্রমশই বাড়ছে। বিদেশি সহায়তা ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় সরকার এ ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। যা এরই মধ্যে রেকর্ড গড়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সরকার ৩১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ব্যাংক খাত থেকে ১৭ লাখ ৮২৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ এই অর্থবছরের সাড়ে চার মাসে (১ জুলাই থেকে ১৫ নভেম্বর) এই ঋণের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদের হার হ্রাস ও নানা কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে এসেছে। সে কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারছে না সরকার। উল্টো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে। আশানুরূপ বিদেশি ঋণ-সহায়তাও আসছে না। আর তাতে বাধ্য হয়ে সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে মতে, নভেম্বর শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গত ৩০ জুনে যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ। আলোচ্য সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। প্রচলিত ব্যাংকগুলো থেকে আগে নেয়া ঋণের দুই হাজার কোটি টাকার মতো ফেরত দেয়া হয়েছে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি চাপ বাড়ছে মূল্যস্ফীতির। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশি-বিদেশি পুঞ্জীভূত ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে সুদ ব্যয়। প্রতিবছরই বেড়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধের ব্যয়। এতে বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। আর বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। উচ্চসুদে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে সুদ ব্যয়।’

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ছিল ৬৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এ সুদ ব্যয় অনুন্নয়ন বাজেটের একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরেও একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এ হিসাবে এক বছরে ঋণ পরিচর্চা বাবদ সুদ ব্যয় বাড়ছে ১১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। সুদ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে তার বেশির ভাগ পরিশোধ করতে হচ্ছে ঋণের সুদে।

আহসান মনসুর বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আদায়ে তেমন গতি নেই। অন্যদিকে কমছে না সরকারের ব্যয়। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। এ জন্য সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যাবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বাজারে সরাসরি মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ ‘হট মানি’ হিসেবে পরিচিত। এক টাকা ছাড়লে পাঁচ গুণ মুদ্রা সরবরাহ বাড়ে। মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি উসকে যায়, কিন্তু ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করতে না পেরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার।

সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে এসেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৬৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণাত্মক (নেগেটিভ) হয়েছে। অর্থাৎ এই চার মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো ৬৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা সরকার তার কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। আর সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর বিপরীতে প্রথম চার মাসে এই খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার, উল্টো ৬৩২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ