আজ ১৪ ডিসেম্বর নাটোরের নলডাঙ্গা হানাদার মুক্ত দিবস। এইদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও মুজাহিদদের কবল থেকে মুক্ত করে নলডাঙ্গাকে। এ দিবসটি উপলক্ষে নলডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন পতাকা উত্তোলনসহ সকালে আনন্দ শোভাযাত্রা, পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।
মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার মজিবর রহমান জানান, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তখন স্থানীয় মুক্তিকামী মানুষ যুদ্ধে অংশ নিতে কেউ কেউ ভারতে যান। আবার কেউ কেউ স্থানীয়ভাবেই ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত প্রতিরোধ লড়াই মুক্তিযুদ্ধ। সে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের কলঙ্কিত অধ্যায়ের বিপরীতে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা।
অন্যান্য এলাকার মত খোলাবাড়িয়া, বাঁশিলা, পাটুল, হাপানিয়া, মাধনগর, সোনাপাতিল, ডাকাতিভিটা ও নলডাঙ্গা গ্রাম থেকে বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। তারা বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে শত্রুকে পরাস্ত করে নিজ এলাকায় ফিরে আসে। পরে তারা নলডাঙ্গা এলাকাকে শত্রু মুক্ত করতে অবস্থান নেয়। তাদের এই অবস্থানের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী পাক সেনাদের জানিয়ে দেয়। ফলে পাক সেনাদের আনাগোনা বেড়ে যায়।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা নলডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মের দক্ষিণে নওপাড়া ব্রিজের পাশে রেললাইন উপড়ে ফেলে। এতে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এবং রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে কেউ এতে হতাহত হয়নি। পরে তা মেরামত করলে রেল চলাচল স্বাভাবিক হয় এবং ট্রেনে করে পাক সেনারা যাতায়াত শুরু করে। ১৪ ডিসেম্বর সকালে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধারা রেল লাইন উপড়ে ফেলে এবং বারনই নদীর উত্তর পার্শ্বে বাঙ্কার করে অবস্থান নেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর পেয়ে বিকেলে পাকসেনারা বাসুদেবপুর থেকে ট্রেনে নলডাঙ্গায় রওনা দেয়। পথে নওপাড়া ব্রিজের কাছে পৌঁছালে লাইন উপড়ে ফেলা দেখে তারা ট্রেন থেকে নেমে মার্চ করতে করতে স্টেশন প্লাটফর্মের দিকে অগ্রসর হয়। পাক সেনারা নলডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে ওঠা মাত্র নদীর উত্তর পাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি বর্ষণ করতে থাকে। পাক সেনারাও পাল্টা গুলি বর্ষণ শুরু করে। এভাবে প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী চলে যুদ্ধ। পাকসেনাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে চলা অসম যুদ্ধে রসদ শেষ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা অন্যত্র সরে যাওয়ার পর পাকবাহিনীর দোসর রাজাকাররা গ্রামে ঢুকে লুটপাটসহ বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পরে তারা গাংগইল গ্রামের আব্দুর রাজ্জাককে গুলি করে হত্যা করে। খবর পেয়ে এয়ার মার্শাল আবুল বাশার ও খালেদ মোশারফ দুটি বিমান নিয়ে আকাশে টহল দিতে থাকে। একপর্যায়ে পাক সেনাদের ওপর বিমান থেকে গুলি বর্ষণ ও বোমা ছুড়তে থাকে। পাক সেনারা পিছু হটতে থাকে। পরে নলডাঙ্গা শত্রু মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও এলাকায় মানুষের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
যুদ্ধে খোলাবাড়িয়া গ্রামের আফাজ, কাজেম, আব্দুস ছাত্তার, বিলজোয়ানী গ্রামের সাহেব আলী দেওয়ান, সামাদ দেওয়ান, বাশিলার অধ্যাপক হুসেন আলী মাস্টার, আব্দুর রাজ্জাক, বাসুদেবপুরের সরদার সাইফুল ইসলাম, সোনাপাতিল গ্রামের ডা. মজিবর রহমানসহ নাম না জানা আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয়।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ