১৯৭১ সালে মানিকগঞ্জে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের ২২টির বেশি সম্মুখযুদ্ধ হয়েছে। এর অন্যতম ছিল ১৩ অক্টোবর হরিরামপুরের হরিণায় সিও কার্যালয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প দখলের যুদ্ধ।
‘হরিণা যুদ্ধ’ নামে পরিচিত সেই সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লিয়াকত আলী। সেদিনের সেই যুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে লিয়াকত আলী নয়া শতাব্দীকে জানান, সম্মুখযুদ্ধে ৫৪ জন পাকসেনাকে হত্যা করে মুক্তিসেনারা।সেদিন হানাদারমুক্ত হয় হরিরামপুর। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
জেলা তথ্য বাতায়ন থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে মানিকগঞ্জ ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ঢাকা পশ্চিমাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। তৎকালীন ঢাকা জেলার ২২টি থানা নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ অঞ্চলটি।
লিয়াকত আলী নয়া শতাব্দীকে জানান, তিনি দুটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ অগাস্ট জেলার বালিরটেক যুদ্ধ এবং ১৩ অক্টোবর হরিণা যুদ্ধে অংশ নেন। তবে হরিণা যুদ্ধ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
তিনি জানান, হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জের হরিণায় সিও কার্যালয়ে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্র এলাকার সবচেয়ে বড় ক্যাম্প। ইপিআর, রাজাকারসহ এই ক্যাম্পে ছিল হানাদার বাহিনীর শতাধিক সদস্য।
সেদিনের সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণায় লিয়াকত আলী বলেন, হরিণা ক্যাম্পে পাক বাহিনীতে থাকা ৪ জন বেলুজ সদস্য নানা কারণে পাকবাহিনীর উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। স্থানীয় নান্নু মিয়ার মাধ্যমে তারা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে চান। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আক্রমণের সাহস বেড়ে যায়। বেলুজ যোদ্ধার সাথে আমাদের কথা হয়। তাদের বলা হয়, পাক সেনারা খেতে বসা পর্যন্ত আমরা নির্দিষ্ট স্থানে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করব। সন্ধ্যায় যখন পাক সেনারা খাওয়ায় ব্যস্ত হবে তখন আমি সংকেত দিলে বেলুচরা বিদ্রোহ করে পাঞ্জাবিদের সারেন্ডার ও আর্মসলেস করাবে। সিদ্ধান্ত হয়, এতে রাজি না হলে বেলুচরা গুলি চালাবে, ইপিআর সেনারা বেলুচদের সঙ্গে যোগ দেবে এবং মুক্তিবাহিনীও আক্রমণ করবে।
লিয়াকত আলীর দায়িত্বে প্রথম গুলি ছোড়ার ভার পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিকল্পনামতো ১৩ অক্টোবর বিকালের আগেই নৌকাযোগে তারা ১২-১৫টি নৌকায় সুতালড়ি পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্য রওয়ানা হন। শেষ বহরে তিনি নিজের নৌকা ছাড়েন। ক্যাম্পের কাছের বুড়ির বটতলায় ১৫ জন এবং পাক হানাদার ক্যাম্পের সামনে থেকে ওয়ারলেস অফিস ডানে রেখে পূর্ব দিকে পাটগ্রাম স্কুলের রাস্তায় তিনিসহ ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন। কিন্তু আমরা পজিশন নিতে না নিতেই ক্যাম্পের ভিতরে ব্রাশ ফায়ারের প্রচণ্ড আওয়াজে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আমি হতভম্ব কী ব্যপার! কী ঘটনা? মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম গুলি চালানোর যাতে বেলুচরা বুঝতে পারে আমরা হাজির। আমার সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর সকলেই গুলি ছুড়তে থাকি।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে মুক্তিবাহিনী এগুতে থাকে। ক্যাম্পের ভিতর থেকে কিছু পাকসেনা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দৌড়ে ঘাটে থাকা লঞ্চে উঠে দ্রুত পদ্মার দিকে চলে যায়। এক পর্যায়ে ক্যাম্পের ভিতর থেকে গুলির শব্দ বন্ধ হয়। আমি জয় বাংলা স্লোগান দেই। সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর সকলেই জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস কাপিয়ে তোলে।
লিয়াকত আলী বলেন, এ সময় বেলুচরা উপরে হাত তুলে অস্ত্র উঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং মুক্তিবাহিনীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সামনে এসে পায়ের সামনে অস্ত্র রেখে স্যালুট দিয়ে হ্যান্ডশেক করে জানায় ক্যাম্পে কোনো আর্মি নেই। বেলুচ সেনাদের সঙ্গে সাত জন বাঙালি রাজাকারও আত্মসমর্পণ করে। তাদের দুই জনের বাড়ি গাজীপুরে ও পাঁচ জনের বাড়ি বরিশাল।
সেদিনের ক্যাম্পের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, অস্ত্রগুলো সরিয়ে ওদেরকে বসিয়ে রেখে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত দোতলায় যান। দোতলায় লাশ আর লাশ, রক্তের স্রোত বইছে। প্রতিটা রুমে তল্লাশি করেন তারা।
তিনি জানান, একটা রুমে ৭-৮ জন নারীকে খুঁজে পাই। বিবস্ত্র অবস্থায় এই নারীদের দুহাত উপরে বাঁধা ছিল। দ্রুত তাদের হাতের বাঁধন খুলে দেই। তাদের চলার শক্তি ছিল না। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কাঁধে নিয়ে তাদের নিচে নামান। এর মধ্যে গ্রামের মানুষ এসে জড়ো হয়। তাদেরকে সরে যেতে নির্দেশ দেই। এরপর উপর থেকে লাশগুলো নামিয়ে মাঠের লাশগুলোর সাথে রাখতে বলেই আমি অস্ত্র সংগ্রহের দিকে নজর দেই।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, সেদিন জমা করা অস্ত্রের মধ্যে ছিল দুইটি এলএমজি, একটি ৩ ইঞ্চি মর্টার, ৩০৩ রাইফেলসহ অত্যাধুনিক চাইনিজ রাইফেল ৮৫টি এবং প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ। এছাড়া বেলুজদের চারটি এলএমজিও মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
লিয়াকত আলী বলেন, এরপর মাঠে রাখা লাশ গুণে দেখা যায় ৫৩টি। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ জন বাঙালি ছিল মনে হয়। অন্ধকার রাতে সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায়নি। পরে ওদের বাংকারে একত্রে ৪-৫টা করে লাশ ফেলে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সকালে পলাতক এক পাক আর্মিকে পেয়ে হত্যা করা হয়, তাকে নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর নিহতদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪।
সেদিনের যুদ্ধে এক সহযোদ্ধাকে হারানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পেট্রোল দিয়ে পাক বাহিনীর ওয়্যারলেস অফিস ধ্বংস করতে যায়। তখন পেট্রোল ভর্তি ড্রাম বিস্ফোরিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান খানের পুরো শরীর আগুনে ঝলসে যায়। এর দুই দিন পর ১৬ অক্টোবর তিনি শাহাদাতবরণ করেন। স্বাধীনতার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতিও ছিলেন।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ