আজ ১৩ ডিসেম্বর। বগুড়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে বগুড়া শহর হানাদারমুক্ত হয়। ওই দিন বগুড়া তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায় নেমেছিল।
১৩ ডিসেম্বরের আগে ১০ ডিসেম্বর থেকে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মরণপণ কামড় দিয়েছে। আকাশে মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান, মাটিতে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর অভিযান। দিশেহারা পাকহানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ২৮ নভেম্বর শনিবার সারিয়াকান্দি থানা প্রথম হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। এরপর একে একে বগুড়ার সোনাতলা, গাবতলী, শিবগঞ্জ, ধুনট, শেরপুর মুক্ত হয়। ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া সদর, কাহালু, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া থানার পাক বাহিনীর পতন ঘটে। আদমদীঘি ১৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়। (তথ্য : জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ)
মুক্তিযোদ্ধাদের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, ১৩ ডিসেম্বর বগুড়ার কয়েকটি জায়গায় পাকহানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই দিনে বগুড়ায় আব্দুস সবুর সওদাগর ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে দুটি দল প্রায় একইসঙ্গে বগুড়া শহরে প্রবেশ করে। তবে এ দুটি দলের পেছন থেকে নেতৃত্ব দেন সবুর সওদাগরের বড় ভাই তৎকালীন ইপিআর সদস্য মাহবুবর রহমান সওদাগর। এটিএম জাকারিয়ার নেতৃত্বে ৫২ জনের একটি দল কাহালু থেকে বগুড়া শহরে এসে পৌঁছায় ১৩ তারিখেই। মিত্রবাহিনী বগুড়া শহর পুরো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর বিশিষ্ট প্রকৌশলী আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে বর্তমান পৌর কাউন্সিলর শাহ লুৎফর রহমান আলাল, শহীদ চাঁন্দুদের দল সারিয়াকান্দি থেকে শহরে পৌঁছায়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম মন্টু হানাদার মুক্ত দিনটির কথা স্মরণ করতে পারেননি। তিনি বলেন, ১৩ ডিসেম্বর বগুড়া শহর মুক্ত হয়েছিল। মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তারা শহরে প্রবেশ করেন। শহরে প্রবেশের সময় ওইদিন তুমুল লড়াই হয়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আমিনুল ইসলাম পিন্টু জানান, তিনি ১২ ডিসেম্বর বগুড়া শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে গাবতলী উপজেলা মুক্ত হওয়ার পর গাবতলীর মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে বিজয় উল্লাসে শামিল ছিলেন।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের জেলা আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা মাসুদার রহমান হেলাল বলেন, ১৩ ডিসেম্বর পাক বাহিনী বগুড়া পৌর পার্কে মুক্তিযোদ্ধাদের আরও একটি দল পাক সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য শিবগঞ্জ থেকে বগুড়া শহরে ঢুকেছিল। তার পরিষ্কার মনে আছে হিলি সীমান্ত থেকে বগুড়ায় ঢোকার পর মহাস্থানে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর শক্ত প্রতিরোধে পড়েছিল।
মহাস্থানের টিলায় পাক বাহিনী অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য ও হানাদার পাক বাহিনীর সৈন্য নিহত হয়েছে। তার দাবি মতে, পরাজিত হানাদার পাক বাহিনী বৃন্দাবনপাড়ায় নয়, শহরের এডওয়ার্ড পার্কে আত্মসমর্পণ করেছিল। তাদের ভয় ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তারা তাদের মেরে ফেলতে পারে। তারা সেখান থেকে পাক বাহিনীর ১৩৭ জনকে আহত এবং ৩৭ জনের মৃতদেহ পেয়েছেন। ১৪ ডিসেম্বর সকালে তারা জনশূন্য শহর দেখতে পান।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভোরে মিত্র বাহিনী (ভারতীয় সেনা) এ ৬৪ মাউনটেন্ট রেজিমেন্টের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেমসিংহ এক ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে বগুড়া শহরের ৩ কিলোমিটার উত্তরে নওদাপাড়া-চাঁদপুর ও ঠেঙ্গামারা গ্রামের মধ্যবর্তী স্থান লাঠিগাড়ী মাঠ সংলগ্ন বগুড়া-রংপুর সড়কে অবস্থান নেয়। আর্টিলারি ডিভিশন সেখানে বাঙ্কার খনন করে অবস্থান নেয়। তারা বগুড়া শহরে পাক সৈন্যদের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে শহরে অভিযান পরিচালনার জন্য ফ্রন্ট ফাইটার গোর্খা বাহিনীর সৈন্যরা ট্যাংক নিয়ে শহর অভিমুখে মার্চ করে।
১০, ১১ ও ১২ ডিসেম্বর বগুড়ার সকল উপজেলায় তুমুল যুদ্ধ হয়। ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে বলে সংবাদ পাওয়া গেলে বগুড়াবাসীসহ মিত্র বাহিনীর শিবিরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ১৩ ডিসেম্বর রাতের পর থেকে বুক ভরা শ্বাস ফেলে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষ।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ