লক্ষীপুরের কমলনগরে কৃষিজমি দখল করে নির্মিত হচ্ছে একের পর এক বাংলা ইটভাটা। পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের অনুমোদনহীন এসব ইটভাটায় পুড়ছে কাঠ। হুমকির মুখে পরিবেশ। এসব ভাটার কালো ধোয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠেছে গ্রামীন জনপদ।
উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নেই ব্যাঙের ছাতার মতো হঠাৎ গজিয়ে উঠা অবৈধ ৭টি বাংলা ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে লাকড়ি। অন্যদিকে ইটভাটায় ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। ইটভাটায় কাজ করতে এসে কয়েকটি দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহতসহ পৃথক ঘটনায় আহত হয়েছেন ১০ জনের মতো।
অভিযোগ রয়েছে, ইটভাটা তৈরিতে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কমলনগরের কৃষকদের জমি দখলসহ চুক্তিভিত্তিক শিশুদের নিয়োগ ও সামান্য টাকায় শ্রমিক খাটিয়ে এমনকি বাংলা চিমনিতে লাকড়ি ব্যবহার করে ইট পোড়াচ্ছেন প্রায় ২০টি ভাটার মালিক। এতে ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। পাশাপাশি চলছে ফসলি জমির উপরের মাটি কাটার হিড়িক। ইটের মাটি সংগ্রহ করতে কৃষকদের লোভনীয় অফার দিয়ে তিন ও চার ফসলি জমির উর্বর অংশ কেটে নেওয়ায় ভাটার আশপাশের ফসলি জমি কমে যাচ্ছে প্রতিবছর। ফলে ফসলের লক্ষ্যমাত্রা হুমকির মুখে পড়ে। এ ছাড়াও ইটভাটাগুলোকে ঘিরে বাড়ছে অপরাধ কর্মকান্ড।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের নাকের ডগাতে ইট তৈরিতে কৃষকের অভিযোগে আলোর মুখ দেখছে না। অভিযোগ করলেও প্রশাসন আমলে নিচ্ছে না। ইটভাটার কাজ শেষ হলে পরে তারা লোক দেখানো অভিযানে নামেন।
স্থানীয়দের মতে, একটি প্রভাবশালী চক্র চাষাবাদের কথা বলে জমি লিজ নিয়ে ইটভাটা তৈরি করে। পরে লিজের মেয়াদ শেষ হলেও জমি মালিকদের জমি বুঝিয়ে না দিয়ে এভাবে অবৈধ দখল করে ইটভাটা তৈরি অব্যাহতভাবে চালাচ্ছেন তারা। আর প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় ইটভাটাগুলোকে ঘিরে মাদক বেচাকেনা থাকলেও প্রতি বছর পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে অবৈধ বাংলা ইটভাটায়।
উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের কাটাখালী এলাকায় জয়নাল মাঝির বাংলা ইটভাটা, হানিফ কোম্পানির বাংলা ইটভাটা, চরকাদিরা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নিজাম মেম্বারের বাংলা ইটভাটা, চরকাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা আশ্রয়ন প্রকল্পের পরে রাজু চেয়ারম্যানের বাংলা ইটভাটা, চরকাদিরা ইউনিয়নের চরবসু বাজারের উত্তরে আরিফ কোম্পানির বাংলা ইটভাটা, চরকাদিরা ইউনিয়নের ফজুমিয়ারহাট-ইমান আলী মার্কেট সড়কের পাশে দুটি বাংলা ইটভাটা, হাজিরহাট ইউনিয়নের মিয়াপাড়া সবুজ কোম্পানির বাংলা ইটভাটা, করইতলা বাজারের পূর্ব পাশে মুসলিম পাড়ায় একটি বাংলা ইটভাটাসহ প্রায় ২০টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে এ উপজেলায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের রববাজার এলাকায় ফারুক কোম্পানির ইটভাটায় দুর্ঘটনায় নিহত হন শ্রমিক মহসিন। মহসিন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের ঝাউডগি এলাকার হানিফের ছেলে।
নিহতের স্বজন ও মহসিনের ভাই মোসলে উদ্দিনের অভিযোগ, এ ঘটনায় কমলনগর থানায় মামলা করতে না দিয়ে ভাটার মালিক ফারুক সোয়া লাখ টাকা গ্রহণে বাধ্য করেন তাদের। ঘটনার পরদিন সোয়ালাখ টাকাসহ মহসিনের মৃতদেহ পৌঁছে দেন। পরে তারা ১৮ জানুয়ারি মহসিনের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই পারিবারিক কবরস্থানে মহসিনের লাশ দাফন শেষ করেন।
এ ছাড়া ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি অবৈধ ইটভাটার জন্য গাছের গুঁড়ি সরবরাহ করতে গিয়ে ভাটার ট্রাক্টর উল্টে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় স্থানীয় আন্ডারচর এলাকার আলাউদ্দিনের মেয়ে শিশু রিংকুর। অপরজন নিহত হারুন ও আমেনা একই এলাকার বাসিন্দা। এ সময় আহত হন আরও চারজন। আগের ঘটনার এক মাস না যেতেই একইভাবে নিহত হন একই উপজেলার চরবসু এলাকার ছৈয়দ আহাম্মেদের ছেলে ভাটার শ্রমিক আবদুল মালেক (৫৫)।
এ নিয়ে ইটভাটার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি ও বিচ্ছিন্ন ঘটনায় নিহত হন পাঁচজন। এ ছাড়া একই মাসে হানিফ মেম্বারের ব্রিক ফিল্ডে চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত টাকা চাইতে গিয়ে ওই ফিল্ডের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন রামগতির চরসেকান্তর এলাকার ফিল্ড শ্রমিক লিটন (৪৫)।
ওই ভাটার শ্রমিক আনোয়ার হোসেন জানান, ভাটায় শ্রমিক নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা। ভাটার মালিকদের সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসী, মাদকসেবীসহ ডাকাতদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকায় কেউ নির্যাতনের শিকার হলে বিচার পান না। আর তাদের নিয়োগ হয় অগ্রিম টাকায়। তাই তাদের নির্যাতন সহ্য করেই কাজ করতে হয়। এভাবেই চলছে কমলনগর উপজেলার অবৈধ বাংলা ইটভাটাগুলোর কার্যক্রম।
তবে এসব বাংলা ইটভাটা স্থাপনের বিষয়ে কয়েকজন ভাটার মালিক জানান, তারা জেলা-উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই অবৈধ ইটভাটা পরিচালনা করছেন।
এলাকাবাসী অবৈধ বাংলা ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুচিত্র রঞ্জন দাস জানান, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান শুরু করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। যতবড় শক্তিশালী হউক না কেন? এ ব্যাপারে কোনো ধরনের আপোষ করবেন না বলে জানান ইউএনও।
নয়াশতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ