আজ ৮ ডিসেম্বর, নলছিটি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে নলছিটিকে মুক্ত করে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। মুক্তির আনন্দে সেদিন লাল-সবুজের পতাকা হাতে রাস্তায় বেরিয়ে আসে স্বদেশেপ্রমী হাজারো মানুষ।
মুক্তির আনন্দে মুখর সেদিনের নলছিটির অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে নলছিটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার তাজুল ইসলাম চৌধুরী দুলাল বলেন, ৭ ডিসেম্বর আমরা নিশ্চিত হই নলছিটি থানার পুলিশ ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পরাজয় মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৮ ডিসেম্বর সকালে তালতলা মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষরা শহরে আসলে শহর এবং বিভিন্ন ইউনিয়নের হাজারো মানুষ লাল-সবুজের পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে আসে। মুক্তির আনন্দে সেদিন আমাদের চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। একদিকে বিজয়ের আনন্দ অপরদিকে লাখো শহিদের আত্মত্যাগ, মা-বোনদের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা আমাদের চোখের জলে স্মরণ করেছি।
মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো নিয়ে কথা হয় যুদ্ধকালীন কমান্ডার সেকান্দার আলী মিয়ার সঙ্গে। তিনি সেদিনগুলোর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন। বললেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ও ৮ ডিসেম্বরের সেই দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, আমি তখন ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টে হাবিলদার হিসেবে যশোর সেনানিবাসে কর্মরত ছিলাম। ২৫ মার্চ থেকেই একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল, তাই আমার অফিসার মেজর এম এম জামানকে পাকবাহিনীর ফায়ারের পরিকল্পনার কথা জানাই। সে বলল আমি চলে যাচ্ছি, আপনারাও চলে যান। তখন লুঙ্গি পরে বেরিয়ে খাজুরতলা চলে যাই, সেখানে গিয়ে দেখি যে যার মতো পালিয়ে যাচ্ছে। আমিও একদিন পর খুলনা হয়ে বাড়ি চলে আসি। এর একমাস পর মেজর জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। মেজর জলিলের সঙ্গে পেশোয়ারে একসঙ্গে চাকরি করেছি। তার নির্দেশে বরিশালের বেলেস পার্কে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যানে) একত্রিত হই। এরপর মে মাসের ৮ অথবা ৯ তারিখে পঞ্চাশ জন মিলে ক্যাপ্টেন জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে গল্লামারি রাখাল হাজির বাড়িতে যাই।
কথা হয় সেদিক দিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানিদের ওপর হামলা চালাব কিন্তু আমাদের ভুলে তুমুল যুদ্ধ হয় আর আমরা পালিয়ে যাই। পরদিন বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদে নলছিটির ৩১ জন জড়ো হই। এ সময় মেজর জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সবাইকে বরিশাল চলে যেতে বলেন। পাবলিকের ভয়ও ছিল, তাই পায়ে হেঁটে নলছিটি পৌঁছাই। নলছিটি এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের একত্রিত করতে থাকি। এরপর একদিন নূরুল ইসলাম মঞ্জু ব্রিটিশ থ্রিনটথ্রি রাইফেল ও তিনবক্স গুলি পাঠিয়ে দেন । সে গুলি জেলে বাড়ির খাল বর্তমান হাসপাতালের পিছনের খাল (থানারখাল) থেকে সংগ্রহ করি। অস্ত্র পাওয়ার পর চাঙা হয়ে ওঠি এবং আমার বাড়িতে ৪০ জনকে নিয়ে প্রথম মিটিং করি। মিটিংয়ে উপস্থিত সকলকে রুটি, সবজি ও মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করি। অস্ত্র নিয়ে নিরাপদ বোধ না করায় সব অস্ত্র নিয়ে ভবানীপুর বাড়িতে যাই এবং সেখান থেকে সৈলাবুনিয়া মিনা বাড়ির সৈইজ উদ্দিন মিনার ঘরে থাকতাম। তবে দিনে বের হতাম না। ওখানে বসে প্লান করে ৭ আগস্ট চামটা জল থানা আক্রমণ করে সাতটি রাইফেল ও একবক্স গুলি সংগ্রহ করি। তিনি বলেন এরপর ১০ অথবা ১১ আগস্ট কাঠালিয়া থানা রেকি করতে যাই।
১১ জন মিলে কাঠালিয়া থানা আক্রমণ করেতে নৌকা যোগে আওরাবুনিয়ার মজুমদার বাড়িতে পৌঁছাই ১৪ আগস্টের শেষ রাতে। চিড়া, মুড়ি আর কলা দিয়ে নাস্তা করে সকাল সাতটায় থানা আক্রমণ করেতে বের হই। সেখানে একটা বুদ্ধি খাটাই, চামটা জল থানা থেকে আনা সিসি বইয়ের একটিতে ওসি বরাবর লিখে দেই এগারো জন রাজাকার পাঠানোর কথা। থানার সামনে সেকেন্ড অফিসারকে বললে তিনি বলেন, ওসি সাহেব আছেন আপনারা যান। ভিতরে ঢুকে ওসি সাহেবে স্যালুট দিয়ে সিসি দেখালে তিনি বকশিকে আমাদের থানার মধ্যে থাকার ব্যবস্থা করতে বলেন। আমাদের দলের ওয়াহেদ শরীফের দায়িত্ব ছিল থানার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার। সেটি হওয়ার পর আমরা একযোগে গুলি চালালে ওসি ও কনেস্টবল গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে এ দৃশ্য দেখে অন্য পুলিশ সদস্যরা যে যেভাবে পারে পালিয়ে যায়। মাত্র এক ঘণ্টায় আমরা থানা দখল করে নিই। তখন সেখান থেকে ১২০টি রাইফেল ও ৭ বাক্স গুলি সংগ্রহ করি। পরে এক আওয়ামী লীগ নেতার সহযোগিতায় একটা জেলে নৌকায় করে রাত তিনটার দিকে মিনা বাড়িতে ফিরে আসি। এরপর রানাপাশা হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গঠন করি। এবং পরে নলছিটির তালতলাতে আরও একটা ক্যাম্প করি।
যুদ্ধকালীন সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ হয় ১৩ নভেম্বর চাচৈরে। চাচৈর কালুর বাড়ির ক্যাম্প দেখতে আসার কথা সাব সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান ওমরের । অপর দিকে পাক হানাদার বাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ করেতে আসার কথা জানতে পারে মুক্তিযোদ্ধারা। তখন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বাধীন একটি দল, আমার (সেকান্দার কমান্ডার ) একটি দল, বরিশালের করাপুরের সুলতান মাস্টারের একটি দল ও নলছিটির দপদপিয়ার আবদুল মন্নানের নেতৃত্বে একটি দল ঘোষাল স্কুলের সামনে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করি। এই যুদ্ধে নলছিটির কাঠিপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল হোসেন ও দুইজন সাধারণ জনতা শহিদ হন। অপরদিকে ষাট-পঁয়ষট্টি জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয় ।
১৪ নভেম্বর রাতে নলছিটি থানা আক্রমণ করি। এবাবেই ৭ ডিসেম্বর বাখেরগঞ্জ দখল করে নিই। ৮ ডিসেম্বর সকালে মালেক মাস্টারের বাড়িতে ভাত খাওয়ার সময় খবর পেয়ে সঙ্গেসঙ্গে নলছিটি ছুটে আসি। রাজাকারসহ নলছিটি থানার সবাই তখন আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। খবর পেয়ে আশপাশের কয়েক হাজার মানুষ হাতে দা আর বাঁশের লাঠি মুখে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে বিজয় উল্লাসে মেতে উঠে ছিল। পুরো শহর এক অন্য রকম আনন্দে ভাসছিল। পরে বন্দিদের তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আবার সেনাবাহিনতে যোগদান করি এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন সালামে অংশগ্রহণ করি।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ