প্রতিবছরের মতো এবারও শীতের শুরুতে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নড়াইলের খাল-বিল ও জলাশয়ে আসতে শুরু করেছে। এই সুযোগে স্থানীয় চোরা শিকারিরা মেতে উঠেছে পাখি নিধনের মহোৎসবে। সবখানে অতিথি পাখি শিকার যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনও একেবারেই নীরব ভূমিকা পালন করছে।
জানা গেছে, এর মধ্যে নড়াইলের তিনটি উপজেলার চাঁচুড়ী বিল, ইছামতি বিল, কাড়ার বিল, নলামারা বিল, গোপালপুর-বগুড়ার বিলসহ বিভিন্ন খাল-বিল ও জলাশয়ে হাজারো অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে।
অতিথি পাখির মধ্যে রয়েছে, বালি হাঁস, কালকোচ, কায়েম, ডুঙ্কর, পানকৌড়ি, পাতাড়ি হাঁস, হাঁস ডিঙ্গি, কাদা খোঁচা, খয়রা, চেগা, কাচিচোরা, মদনটাক, শামুখখোলা ও বক ইত্যাদি।
সূত্র মতে, প্রতিবছর শীতের শুরুতেই শীত প্রধান দেশগুলো থেকে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। এরা মূলত নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত অবস্থান করে। শীত শেষ হলে আবার তারা নিজেদের দেশে ফিরে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
অতিথি পাখি শিকারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ফাঁদসহ নানা ধরনের অভিনব নতুন প্রযুক্তিগত পদ্ধতি। চোরা শিকারির কারণে এ অঞ্চলে অতিথি পাখির অবাধ বিচরণের স্থানগুলো ক্রমান্বয়ে তাদের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক শিকারি জানায়, এক সময় মাছ ও ফড়িং জাতীয় কীট-পতঙ্গে বিষটোপ দিয়ে, ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে কিংবা ফাঁদপেতে পাখি শিকার করা হতো। তবে এখন পাখি শিকারে শিকারি চক্র তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় সহজেই বোকা বানাচ্ছে এসব পাখিদের। দীর্ঘ দিন ধরে এসব বিল ও জলাশয়ে শিকারি রাতেরবেলা বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাক ডাউনলোড করে স্ব স্ব মোবাইলে। এরপর রাতের আকাশে পাখিদের আনাগোনা দেখে বিল ও জলাশয়ের বৃহৎ এলাকাজুড়ে বড় আকারের জালের ফাঁদ পেতে মোবাইলের মাধ্যমে ওইসব পাখির ডাক সাউন্ডবক্সে বাজানো শুরু করে। এরপর পাখিরা ওই আওয়াজ শুনে মনে করে তাদের অন্যান্য সঙ্গীরা সেখানে অবস্থান করছে। আর শিকারিদের এসব নিত্যনতুন প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে স্বজাতির ডাকের দিকে নামতেই জড়িয়ে পড়ছে পেতে রাখা ফাঁদে। এভাবে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত অভিনব কায়দায় নির্বিচারে পাখি নিধন করছে প্রকৃতি বিধ্বংসীকারীরা।
এছাড়া রাতের নিরাপদ আশ্রয়স্থল থেকে সকালে যখন খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে তখনও পাখিদের শিকারিদের কবলে পড়তে হয়। দিনের বেলায়ও শিকারিরা নাইলনের সুতা দিয়ে তৈরি ছোট-বড় ফাঁদ পেতে রাখে পাখির চলার পথে। আবার বড়শি পেতে, কারেন্ট জাল পেতেও পাখি শিকার করে কোনো কোনো শিকারী। তারা সারা রাত পাখি শিকার করে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই তা বিক্রি করে।
পাখি শিকারি আলীম বলেন,‘বাজারে অতিথি পাখির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাই যে কোনো উপায়ে ধরতে পারলেই বিক্রি করতে সমস্যা হয় না। এমনকি আগে থেকেই বুকিং নেয়া ক্রেতাদের বাড়িতে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই তা পোঁছে যায়। এসব ক্রেতা আবার সমাজের এলিট শ্রেণির লোক বলে জানান তিনি।’
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পাখি শিকারি বলেন,‘আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে টাকা ও পাখি দিয়ে প্রতি রাতেই পাখি শিকার করে থাকি। কারণ প্রশাসনেরও কিছু কর্তাব্যক্তি এই পাখির ক্রেতা।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন,‘অতিথি পাখি আমাদের দেশের একটি সম্পদ। এদের রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিরাপত্তা ২০১২ আইন ৩৮ (১) ধারা মোতাবেক অতিথি পাখি শিকার বা ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ। শিকারীদের শনাক্ত করতে পারলে অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। শিকারিদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ