উপকূলের মানুষের ভয়াবহ স্মৃতির স্বরণে বরগুনা প্রেসক্লাবের আয়োজনে প্রতি বছরের মতো এবারও পালিত হয়েছে সিডর দিবস। স্বরণসভা, দোয়া অনুষ্ঠান, কালো ব্যাজ ধারনের মাধ্যমে পালিত হয় দিবসটি।
মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) সকালে বরগুনার গর্জনবুনিয়ায় সিডর স্মৃতিস্তম্ভে আয়োজিত আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন বরগুনা প্রেসক্লাবের সম্মানিত সভাপতি অ্যাড. সঞ্জীব কুমার দাস।
এ সময় বিশেষ অতিথি ছিলেন, বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব কাওসার হোসেন, নলটোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুজ্জামান মাহফুজ, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপজেলা টিম লিডার জনাব জাকির হোসেন মিরাজ, বরগুনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি জহিরুল হাসান বাদশা, বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাফিজ, প্রিন্ট মিডিয়া সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম টিটু, সাংবাদিক ফেরদৌস খান ইমন, শাহ আলী প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বরগুনা প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি আবু জাফর সালেহ।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের আঘাতে বরগুনা জেলার ১ হাজার ৩৪৫ জন মানুষ মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন, আরো ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদি পশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাস-মুরগি মারা যায়। জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবারের সবাই কমবেশি ক্ষতির শিকার হন। গৃহহীন হয়ে পড়ে জেলার ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। বেসরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার নাম নলটোনা। যেখানে সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ছিলো না। সিডরের সময় সেখানে ২০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরদিনই সেখানে অর্ধ শতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ৩৪ জনকে ১৯টি কবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়। জায়গার অভাবে ৪টি কবরে ৩ জন করে ১২ জন, ৩টি কবরে ২ জন করে ৬ জন ও ১২টি কবরে ১ জন করে ১২ জনের লাশ দাফন করা হয়। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে।
বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে ইট দিয়ে কবর স্থানটি ঘিরে দিয়েছিলো। বর্তমান জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় সেখানে সিডর স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছেন। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এসে থমকে দাঁড়ায়। কেউ কেউ কান্না চেপে রাখতে পারেন না। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে কবরগুলো।
কবরগুলোতে শুয়ে আছেন, নলটোনা গ্রামের তাসলিমার বাবা আবদুর রশিদ (৫৫), মা আম্বিয়া খাতুন (৫০), ছেলে আল আমিন (৭), ফোরকানের বাবা দিন আলী (৬৫), হাসি বেগমের মেয়ে শাহিনুর (৪), শাহজাহানের মা তারাভানু (৬০), মেয়ে খাদিজা আক্তার (৩), আনিসের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৩০), ছেলে আবু বকর (৩), রফেজ উদ্দিনের স্ত্রী বিউটি বেগম (৩৫), মাসুমের মা হেলেনা আক্তার (৩০), বাদলের মা লালবরু (৬৭), বাবুলের মেয়ে জাকিয়া আক্তার (৮), আবদুস সত্তারের স্ত্রী সাফিয়া খাতুন (৩০), ছেলে রেজাউল (১২), রেজবুল (৭), মেয়ে সাবিনা (৯), সগির হোসেনের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (৩), আবদুর রবের ছেলে হোসেন আলী (১২), মেয়ে ময়না (৭), হোসনেয়ারা (৫), শাশুড়ী মনোয়ারা বেগম (৫০), সরোয়ারের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার (৩০), মেয়ে রোজিনা (৪), ছত্তারের স্ত্রী বেগম (৫০), পুত্রবধূ নাজমা আক্তার (৩০), নাতি পারভেজ (৪), নাসির উদ্দিনের স্ত্রী হোসনেয়ারা (২৬) ও গর্জনবুনিয়া গ্রামের গনি বিশ্বাসের ছেলে জাহিদ হোসেন (৫)।
উপকূলীয় বরগুনায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাম সাইক্লোন শেল্টারসহ বরগুনায় ৫০০ এর মতো আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে দুর্যোগের সময় সর্বোচ্চ ২ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। ১০ লক্ষাধিক মানুষের জন্য পর্যাপ্ত নয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাইক্লোন শেল্টারের অভাবে বেশির ভাগ মানুষই নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারে না, যার ফলে উপকূলের আশ্রয়হীন মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, আরও সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ