খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক বলেছেন, ২০১০ সালের কপ সম্মেলনে থেকে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশসহ অনুন্নত দেশগুলো। ২০১০ সালে কপ সম্মেলনে প্রথমে সেই দাবিটি তুলে ধরেছিলেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কপ সম্মেলনে শুধু এটি আলোচনাই হয়, বাস্তবায়ন হয় না। সুতরাং এখন সময় এসেছে সম্মিলিতভাবে সকলকে এগিয়ে এসে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতি ও ঝুঁকি কমিয়ে আনার চেষ্টা করার।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খুলনা তথা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ষাটের দশকে উপকূলীয় অঞ্চলে যেসব বেড়িবাঁধ করা হয়েছিল সেগুলো কিছু স্বার্থান্বেষি মানুষ কেটে লবন পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করার ফলে ধীরে ধীরে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে।
খুলনা মহানগরীর জলাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার উন্নয়নে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু ওই অর্থ দিয়ে ড্রেন-রাস্তার উন্নয়ন হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত রূপসা নদী খনন করে গভীরতা সৃষ্টি করা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব হবে না।
সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো- এমনটি উল্লেখ করে সিটি মেয়র বলেন, এদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তা থেকে এ অঞ্চলের মানুষ রক্ষা পেয়েছে সুন্দরবনের কারণে। অথচ এই বনকে উজাড় করে দিচ্ছে কিছু কুচক্রী মহল। কিছু অসাধু রাজনীতিবিদের কারণে বন ধংস হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। যারা বন ধংস করছে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে এগিয়ে আসারও আহবান জানান সিটি মেয়র।
সম্মেলনে শিশুদের বিভিন্ন দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, শিশুদের এসব দাবির ম্যাসেজ কপ সম্মেলন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দেশের পক্ষ থেকে যারা কপ সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসেবে যাবেন তাদের কাছে প্রয়োজনে লিখিত আকারে এসব দাবি তুলে ধরারও আহবান জানান তিনি।
সিটি মেয়র বুধবার খুলনা নগরীর রূপসাস্থ কারিতাস মিলনায়তনে দ্বিতীয় উপকূলীয় শিশুদের জলবায়ু সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগ্রত যুব সংঘ-জেজেএস দিনব্যাপী এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
জেজেএস’র নির্বাহী পরিচালক এটিএম জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন, খুলনার জেলা প্রশাসক মো: মনিরুজ্জামান তালুকদার, খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এসএম নজরুল ইসলাম, ইউনিসেফ খুলনার চীফ ফিল্ড অফিসার মো: কাউসার হোসাইন, শাপলানীড় বাংলাদেশ’র কান্ট্রি ডিরেক্টর তমুকু উচাইয়ামা, কেএনএইচ বাংলাদেশ’র কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর শুভময় হক ও কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’র ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর গ্রেটা ফিটগ্যারাল্ড।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন, বুয়েটের ওয়াটার এন্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লিনের প্রফেসর মোহাম্মদ রেজাউর রহমান, ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের সদস্য সচিব নাঈম ওয়ারা, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রতিনিধি মাহফুজ আলম, কারিতাস’র আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক দাউদ জীবন দাস, ম্যাক্স ফাউন্ডেশনের এডভোকেসী ম্যানেজার ফয়সাল হোসেন, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর এমরানুল হক, একশন এইড’র ম্যানেজার মৌসুমী বিশ্বাস, এডুকোর প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহীনুর ইসলাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেষ্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. নাজমুস সা’দাত, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক শিশু ফোরামের বৈশাখী সরকার ও রাকিবুল ইসলাম, উপকূলীয় এলাকার শিক্ষার্থী যুবরাজ সরকার ও জয়ত্রী মন্ডল।
উদ্বোধনী অধিবেশনে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন জেজেএস’র ডিরেক্টর প্রোগ্রাম এমএম চিশতি ও শিশু ফোরামের সদস্য পুজা বিশ্বাস।
সম্মেলনে শিশু বক্তারা শিশুবান্ধব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবেশ ও দেশ উপহার দেয়ার দাবি জানান। তারা বলেন, বাংলাদেশের যে কোন দুর্যোগে শিশুদের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে খাদ্য, পানি সংকটসহ সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় সামাজিক দুরাবস্থা। এক পর্যায়ে লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক যাতায়াত বাধাগ্রস্থ হয়। অথচ দেশের যে কোন পরিকল্পনায় শিশুদের রাখা হয় না। এজন্য তারা দেশের উন্নয়নসহ যে কোন পরিকল্পনায় শিশুদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার দাবি জানান। আয়োজক সংস্থা জেজেএস’র নির্বাহী পরিচালক এটিএম জাকির হোসেন প্রারম্ভিক বক্তব্যে শিশুদের নিয়ে ভাবেন এমন নেতৃত্ব প্রত্যাশা করেন।
সম্মেলনে জলবায়ু বিষয়ক ছয়টি সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এসব সেশনে সভাপতিত্ব করেন, ফাউন্ডেশন অব ডিজাস্টার ফোরাম’র সদস্য সচিব নাঈম ওয়ারা, ইউনিসেফ’র খুলনার ফিল্ড অফিসার শাহনাজ বেগম, বুয়েটের প্রফেসর মোহাম্মদ রেজাউর রহমান, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হেড অব সাব অফিস মাহফুজ আলম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. দিলিপ কুমার দত্ত এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান এন্ড রুরাল ডিসিপ্লিনের হেড প্রফেসর ড. মোস্তফা সারোয়ার।
এসব সেশনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, শিশুদের নিয়ে ভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বেসরকারি সংস্থা ইডুকোর যুব শিশুরা, আমীর হামজা, মো: আব্দুর রহমান, তিথি রানী খান, রাবেয়া সুলতানা, রেজবিনা খানম, তাসফিয়া তাবাসসুম জান্নাতি, মো: আশফিকুর রহমান, জিএম সোহরাওয়ার্দী, মিসেস মনিরা আক্তার, তানাজিল সওগাত, মো: মাসুম তালুকদার, মো: সবুজ শেখ, গৌরাঙ্গ নন্দী, মশিউর রহমান, সুইটি খাতুন, প্রফেসর নাসিফ আহসান ও এমরানুল হক।
প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন প্রফেসর তুহিন রায়, দাউদ জীবন দাস, এসএম জাহিদ হোসেন, ফারহানা আক্তার লামিয়া, সহযোগী অধ্যাপক নুজহাত ফাতেমা, সুরাইয়া সিদ্দিকা, মৌসুমী বিশ্বাস, মো: আরেফীন বাদল, হাসান মেহেদী, জাহিদ বিন আজাদ, শফিকুল ইসলাম, মাহফুজুর রহমান মুকুল, এমডি সাবেরুল আলম, প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী, রোটা: কামরুল করিম বাবু, খো: রুহুল আমিন, মাহমুদ হাসান, মুমিনুননেসা প্রমুখ।
সম্মেলনে শিশুদের পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবিনামা পেশ করেন মোসা: বৃষ্টি ও মেঘলা আক্তার মোহনা। দাবিনামায় উপকূলীয় বন্যা দুর্গত শিশুদের সুরক্ষায় সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের পদক্ষেপ নেয়া এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরিকল্পনায় শিশুদের বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া, দুর্যোগের ফলে শিশুদের শিক্ষা ও বিনোদন ব্যহত হওয়ার ফলে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় বিধায় সেদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দেয়ার আহবান ও জলবায়ু বিষয়ক আলোচনায় শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, শিশুবান্ধব আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা ও জনপ্রতিনিধি তথা সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন, উপকূলের প্রতি সরকারকে আরও বেশি নজর দেয়া ও ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে শিশুদের বিষয়টি বিবেচনায় আনা, উপকূলীয় অঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদে প্রয়োজনীয় দুর্যোগ মোকাবেলা তহবিল নিশ্চিত করা, ধনী দেশে পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা, উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় বিশেষ বরাদ্দ রাখা ও কৃষি-মাছ, লবনাক্ততা থেকে জীবন-জীবিকা রক্ষা করা, যেসব শিশু উপকূলীয় এলাকা থেকে পরিবারের সাথে শহরে আশ্রয় নিয়েছে তাদের লেখাপড়ার নিশ্চয়তা দেয়া, নগর পরিকল্পনায় শিশুদের কথা চিন্তা করে প্রয়োজনীয় পার্ক ও সাঁতার শেখার জন্য পর্যাপ্ত পুকুর স্থাপন/রক্ষা করা এবং খাবার পানি, ব্যবহারের পানি এমনকি সেচের পানির নিশ্চয়তা দেয়ার কথা তুলে ধরা হয়।
বিকেলে সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ইকবাল হোসেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খান মোতাহার হোসেন, খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মামুন রেজা প্রমুখ।
একশন এইড, কারিতাস, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড, এডুকো, কিন্ডার নট হাইফ, ম্যাক্স ফাউন্ডেশন, শাপলা নীড় ও ইউনিসেফের সহায়তায় জেজেএস দ্বিতীয়বারের ন্যায় এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ