ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মহাজনের চড়া সুদে চিঁড়েচ্যাপ্টা জেলে

প্রকাশনার সময়: ৩০ অক্টোবর ২০২২, ১০:২৫
সুন্দরবনের শুঁটকিপল্লি

ডাঙ্গায় বাঘ-বনদস্যু, জলে কুমির-জলদস্যুর উৎপাত। রয়েছে বনরক্ষীদের হয়রানি। এর মধ্যেও সুন্দরবনের দুবলা শুঁটকিপল্লির ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন জেলেরা। কিন্তু তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। মহাজনের সুদের মাশুল গুনতেই জীবন শেষ হয় অনেকের। তারপরও অনেকেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই এ পেশায় টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।

ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আশা শুঁটকিপল্লির কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে মগ বা সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় জেলেরা সুন্দরবনের দুবলার চরে অস্থায়ী ঘরবাড়ি তৈরি করে মৎস্য আহরণ করত। আশির দশক থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় শুঁটকির জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ শুরু করেন। সেই থেকে নানান প্রতিকূলতার মধ্য থেকে জেলেরা মৎস্য আহরণ করে আসছে। জেলেরা ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির-হাঙ্গর, বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও বনরক্ষীদের হয়রানির মধ্যেও তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।

খুলনা, বাগেরহাট জেলার রামপাল, মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এলাকার পাঁচ শতাধিক জেলে বহরদারসহ সাতক্ষীরা ও পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ও কয়েকশ’ জেলে সাধারণত সুন্দরবন থেকে মৎস্য আহরণ করে থাকেন। প্রতি জেলে বহরদার সুদে মহাজনদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকেন। এতে ৫০০ জেলে বহরদারের বিপরীতে সুদে মহাজনদের কাছ থেকে অবৈধ পন্থায় ৫০ কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিতে হয়। ওই ঋণের বিপরীতে জেলেদের লাখে সুদ গুনতে হয় ২৫-৩৫ হাজার টাকা। অথচ তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে জেলেদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হলে তাদের অনেক সাশ্রয় হয় বলে তারা জানান।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৩২৫ জন শুঁটকিপল্লির জেলের কাছ থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা ও ২০১৯-২০ সালের অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৮৭ জন শুঁটকিপল্লির জেলের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৪৮ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ৪ কোটি ১৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা সরকারিভাবে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় বেড়ে ২৭ লাখ টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।

সরকার ও বন বিভাগের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করা ও বনবিভাগের অসাধু সদস্যদের হয়রানি বন্ধ হওয়ায় এবং নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবন ও উপকূলীয় শুঁটকিপল্লি থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

জেলেরা জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ করে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব দিলেও জেলেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি। তারা জানান, মৎস্য সমিতির মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায়, চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী বা ভাসমান হাসপাতাল না থাকায়, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য সাইক্লোন শেল্টার ও সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জেলেদের। গত ৪০ বছর ধরে সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু কোনো সরকারই তাদের কথা রাখেনি। বিগত ও বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিরা এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আশ্বাসের পর আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কেউ তা কখনও পূরণ করেননি।

সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ শুকুর আলী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে তিনি এ পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তার ৬টি জাল, ৩টি ট্রলার ও ২৮ জন কর্মচারী নিয়ে চলতি শুঁটকি মৌসুমে সুন্দরবনে যেতে হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এ মৌসুমে সাবাড় (বহার) নিয়ে সমুদ্রে যেতে হলে ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন। এ টাকার চাহিদা পূরণ করতে আমাকে ব্র্যাক এনজিও থেকে ১০ লাখ টাকা, আশা এনজিও থেকে ৪ লাখ টাকা ও বাকি ৬ লাখ টাকা এলাকার সুদে মহাজনদের কাছ থেকে মাত্র সাড়ে ৫ মাস মেয়াদে চড়াসুদে ঋণ নিতে হয়েছে।’

একই কথা বলেন জেলে ফরহাদ শেখ। তিনি জানান, ‘প্রায় ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে তাকে সাগরে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা ও বাকি টাকা চড়াসূদে এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে ১ লাখ টাকায় ২৫ হাজার টাকা করে সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। যা মাছ ধরার পর পরই পরিশোধ করা শুরু করতে হবে।

সমুদ্রগামী জেলেপল্লির সভাপতি শহিদ মল্লিক জানান, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাই না।’

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মায়ের মতো আগলে রেখেছে। কিন্তু আমাদের লোভের বলি হয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এ বন। এ বনকে রক্ষা না করলে আগামীতে এ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে বিপন্ন হতে পারে। এ জন্য বনের বাস্ততন্ত্র বা ইকো সিস্টেম রক্ষায় সরকারি-বেসরকারিভাবে সবাইকে সমান উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসতে হবে। জেলেরা যাতে বাস্ততন্ত্র রক্ষা করে শুঁটকির জন্য মৎস্য আহরণ করতে পারে সে জন্য বন বিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।’

সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও মুহম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ বনকে আমাদের বনবিভাগের চৌকস বাহিনী দিয়ে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গোটা সুন্দরবনে আধুনিক স্মার্ট প্যাট্রলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালসহ অন্য পেশাজীবীরা যাতে নির্বিঘ্নে বনজ সম্পদ আহরণ করতে পারে সে জন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ