নওগাঁর পত্নীতলায় যতনী পতনী দেড়শ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) উপজেলার আত্রাই নদীর কোলঘেষা যতনী পতনী মন্দির চত্বরে সকাল হতে শুরু হয় লোকজনের আগমন এবং সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পর্যন্ত চলে এ গ্রামীণ মেলা। এলাকর প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে ১২৮০ বঙ্গাব্দ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রায় দেড়শ বছর ধরে নজিপুর পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড মামুদপুর গ্রামে হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ এই মেলা।
হিন্দু শাস্ত্রের তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী, দ্বীপাবলি বা কালিপূজা উপলক্ষে প্রতিবছর বসে এই মেলা। করোনার কারণে গত কয়েকবছর মেলা তেমন ভালো বসেনি তবে এবারের মেলা জমেছে বেশ চমৎকারভাবে।
এই মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ মানুষের মধ্য এক অন্যরকম উৎসব আমেজে মুখোর হয়ে ওঠেছে আশপাশের ১০-১২টি গ্রাম। বাড়িতে বাড়িতে আনন্দ উল্লাস।
গৃহিনীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ধানচালা কুলা, চালুনি, ডালা হাঁসুয়া বটি পাতিলসহ ইত্যাদি ক্রয় করেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই জামাই মেয়েসহ বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন আসা, চলে খাওয়া-দাওয়ার ধুমও। পোলাও, পাটিসাপটা, দুধকুসলি, কানমুচরি, পাকোয়ান পিঠা, রস পিঠাসহ নানান পিঠাপুলি মিষ্টি মিঠাই খাওয়ার ধুম। নিতান্ত গরীব হলেও ১ কেজি জিলাপি কিনবেই।
একদিনের এ মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে দোকানিরা আগের দিন এসে দোকানে মিষ্টি, বাঁশ, বেত, মাটির তৈরি নকশি পাতিল, মাটির ব্যাংক, পুতুল, কাঠের তৈরি ফার্নিচার, কসমেটিক, খেলনা, বাঁশি, বেলুন, ঘুর্নি, লোহার তৈরি হাঁসুয়া বটি, চাকু, কাগজের ফুল নানা রকম মুখরোচক খাবারেরর দোকান দিয়ে নানান জিনিসপত্রের পশরা সাজিয়ে বসেন।
শ্রী নিতাই কুমার পাল নামের এক দোকানি জানান, র্দীঘ ৫০ বছর ধরে এই মেলাতে মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করে আসছি। শুরুর দিকে আমার দাদু এই মেলাতে মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করতেন। এরপর আমার বাবা অমূল্য চরণ পাল তারপর আমি এসব বিক্রি করছি। এখানে মাটির তৈরি হাড়ি,পাতিল, ঢাকোন, প্রদীপ দেওয়া ছোট বাটি, ধুপ জালানো ধুপতীসহ নানা রকম মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করি আমরা।
মেলাতে বাশেঁর তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসা রেবেকা পাহান জানান, সারা বছর আমাদের খুব কষ্টে দিন কাটে। এই সময়টা আমরা বাশেঁর তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করি। মেলাতে আমরা বাশেঁর তৈরি কুলা, ঢাকনা, ঝাল ডালা, খইচালা, চালুন, মাছ রাখা খলইসহ বাশেঁর তৈরি নানা উপকরণ বিক্রি করি। প্লাস্টিকের পণ্য বাজারে আসায় আমাদের আয় কমে গেছে।
স্থানীয় রতন হালদার, মানিক, শুশান্তসহ অনেকেই জানান, আসলে এই মেলা কবে থেকে শুরু হয়েছে, তা সঠিক বলা মুসকিল। তবে বাবা-দাদার হাত ধরে খুব ছোট থেকে এ মেলায় আসছি। বছরের এই একদিনের জন্য মেলা হয়। মেলাতে এই এলাকার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষেরা আসেন। এখানে সারা বছরের সংসারের প্রয়োজনীয় নানা রকম জিনিসপত্র পাওয়া যায়। মানুষেরা এগুলো কিনে সারাবছরই ব্যবহার করে থাকেন।
মেলার এক পাশে চলে ‘বউ মেলা’। বউ মেলায় বিশেষ করে নারীদের কসমেটিক দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের শত শত নারীদের বউ মেলায় আগমন ঘটে।
মেলা দেখতে আসা চৌরাট শিবপুর বরেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ বাবু দিপক কুমার সরকার বলেন, আমার জানামতে পাকিস্তান প্রিয়ড থেকে যুগ যুগ ধরে এই মেলা হয়ে আসছে। এখানে যতনী পতনী নামে দুটা কালি ছিল, যতনী ইন্ডিয়া গেছে, আর পতনী এখানে আছে। এখানে জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের পদচারণা হয়। আমি আশা করব, আগামীতেও এভাবে সৌহার্দ্য সম্প্রিতির মেলবন্ধনে আরও বড় উৎসব হোক।
নজিপুর মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মেলা কমিটির সভাপতি বাবু দিলিপ কুমার মন্ডল জানান, বিগত ১০ বছর যাবত আমি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। মেলার জন্য কোনো চাঁদা কালেকশন করা হয় না। মানুষ স্ব-ইচ্ছায় যে যা দেয় তাতেই হয়ে যায়। মজার বিষয় সৃষ্টি কর্তার কি মহিমা মানুষ যা টাকা দেন হিসাব অনুযায়ী টাকা বেশি হবেই। ১২৮০ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকেই এখানে মেলা বসে। মূলত দ্বীপাবলি উৎসবকে কেন্দ্র করে আমরা এই মেলার আয়োজন করে থাকি। এ দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা কালিপূ অর্চনা করেন এখানে। ধর্ম-বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আসেন এ মেলায়।
নয়াশতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ