ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মিথ্যা মামলাই অস্ত্র তার!

প্রকাশনার সময়: ১১ অক্টোবর ২০২২, ০০:০৩ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২২, ০০:০৬

ছিলেন টিউবওয়েল মিস্ত্রী। বাড়ি বাড়ি নলকূপ স্থাপন করে চলতো তার জীবন-জীবিকা। হঠাৎ করেই পেয়ে যান আলাদীনের চেরাগ- আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠে তার। রাতারাতি গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। আর এসব করতে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন সাজানো মামলা। হয়রানী করে নিঃস্ব করে দেন সাধারণ মানুষকে। মামলাবাজ হিসেবে বিশেষভাবে কুখ্যাতি পাওয়া এই ব্যক্তির নাম আলেপ বেপারি। বসবাস ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা মুন্সিগঞ্জে।

সূত্র জানায়, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বালাসুর গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে মুর্তিমান আতঙ্কের নাম আলেপ বেপারি। ওয়ারিশ ও অংশীদার ঠকানোই যেন তার পেশা। মৃত ছমির উদ্দিন বেপারির পুত্র আলেপ বেপারি চাঁদাবাজী ও মিথ্যা মামলা দিতে নান্নু মুন্সি ও ছানি মুন্সিকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি বাহিনী। এই চক্র দীর্ঘদিন এলকার হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানী করে আসছে। তাদের রোষানলে পড়ে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। মিথ্যা মামলায় হয়রানীর ভয়ে চরম আতঙ্কিত এলাকাবাসী। সম্মান হারানোর ভয়ে কেউ কেউ আবার এ চক্রের সাথে আপোষ করে নিচ্ছেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানীর বিষয়টি এলাকায় ওপেন সিক্রেট। তবুও চক্রটি অদৃশ্য কারণে থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে দায়ের হওয়া অনেকগুলো মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট ১০-১২ জনের একটি চক্রই ঘুরেফিরে মামলার বাদী আর সাক্ষী হচ্ছেন। এদের মধ্যে থেকেই একজনকে বাদী করে অন্যদেরকে মামলায় সাক্ষী বানানো হচ্ছে।

জানা গেছে, টিউবওয়েল মিস্ত্রি থাকাকালে শ্রীনগর এলাকায় প্রায় আট একর জমি অংশিদারিত্বে ক্রয় করার কথা বলে আলেপ বেপারী কিছু পরিচিত লোকদের কাছ থেকে টাকা নেন। জমি কেনা হলেও পরবর্তীতে অংশীদারদের না দিয়ে জমি নিজের নামেই রেজিস্ট্রি করেন। অন্যদিকে, অংশীদারদের টাকা ফেরত না দেয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে কোনঠাসা করে ফেলে। সাজানো মামলায় সাধারণ মানুষকে হয়রানীর এমন অভিজ্ঞতাকে বার বার কাজে লাগাতে শুরু করেন আলেপ বেপারী। বিত্তবান ও জমির মালিকদের টার্গেট করে পাতেন ফাঁদ। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে মিথ্যা মামলাই যেন তার মূল অস্ত্র। বিভিন্ন অজুহাতে মামলা করার নেশা পেয়ে বসে আলেপ বেপারীকে। আর এর মাধ্যমে একের পর এক ঘায়েল করতে থাকেন মানুষের সম্পত্তি। আর এই কাজের জন্য গড়ে তোলেন দলিল ও ওয়ারিশ সার্টিফিকেট জালিয়াতিসহ একটি জালিয়াত সিন্ডিকেট। এদিকে একই এলাকার সিরাজ মীরকে পুড়িয়ে হত্যা করে এই চক্র। মৃত্যুর আগে সিরাজ মীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আলেপ বেপারী ও তার সহযোগীদের নাম উল্লেখ করে জবানবন্দি দিয়ে গেছেন।

শ্রীনগরের বালাশুর গ্রামের বাসিন্দা মো. জুলহাস বেপারী বলেন, আলেপ বেপারীদের দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় আমার ভাই, শ্বশুর, শ্যালক, মামাতো ও খালাতো ভাই সহ মোট ১৬ জনের নামে ২০১৪ সালে মিথ্যা মামলা দেয়। মামলা নং- সি.আর ২৪২/২০১৪। এই মামলায় চার বছর আদালতে হাজিরা দিতে দিতে এক পর্যায়ে হয়রানী থেকে রক্ষা পেতে বাধ্য হয়েই আলেপ বেপারীকে তাদের দাবিকৃত চাঁদার টাকা পরিশোধ করে মামলা আপোষ করি।

সূত্র মতে, স্বাধীনতা বিরোধী আলেপ বেপারীর রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি হয় জাতীয় পার্টির আমলে মরহুম শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের পৃষ্ঠপোষকতায়। পরবর্তীতে তিনি বিএনপি’র রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। ছাত্রদলের এক প্রভাবশালী ছাত্র নেতার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেন আরো শক্তিশালী। আর সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং মামলাবাজিকে পুঁজি করে রাতারাতি সম্পদের মালিক হয়ে যান। এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আইন আদালতের ফাঁক-ফোকর আর টাকার জোরে তিনি এখন এক মূর্তিমান আতংক। এই আতংককে কাজে লাগিয়ে তিনি এখন একের পর এক তার অভিষ্ট লক্ষ্য জয় করে চলেছেন।

আলেপ বেপারীর ভাতিজা মো. মোয়াজ্জেম বলেন, আলেপ বেপারীর রোষানলে আর সাজানো মামলায় পড়ে নিস্বঃ হয়ে গেছি। বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় এখন তাকে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তবে এলাকাবাসী তার উপর চরম ক্ষুদ্ধ হয়ে আছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলেপ বেপারীর এক ভাগিনা বলেন, আলেপ বেপারী আমার আপন মামা। আর আমার মা খালারা ৩ বোন। কিন্তু আলেপ বেপারী জাল ওয়ারিশ সার্টিফিকেট তৈরী করে তা দিয়ে আমার নানার সকল সম্পত্তি একার নামেই নামজারি করিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে আসল ওয়ারিশ সার্টিফিকেট তুলে আমরা আদালতের স্মরনাপন্ন হলে তিনি আরো ক্ষুব্ধ হয়ে আমি ও আমার খালাতো ভাইদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা দেন।

অভিযোগ রয়েছে, আলেপ ব্যাপারীর এই গ্যাং তাদের টার্গেটকৃত ব্যাক্তির কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। চাদা দিতে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে হেনস্থা করতে চক্রের সদস্যদের বাদী করে দায়ের করে সাজানো মামলা।

ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মুন্সিগঞ্জ কোর্টে গত ৩০ বছরে দুই শতাধিক মামলার বাদি আলেপ বেপারী ও তার বাহিনীর সদস্যরা। তার বিবাদীর সংখ্যা হাজার হাজার। সম্পদশালী সংখ্যালঘু পরিবারগুলো বাধ্য হয়েছে এলাকা ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে। তার সহযোগী নান্নু মুন্সি, এবং নান্নুর ছেলে ছনি মুন্সি তার সকল মামলার সাক্ষী। বালাশুর অঞ্চলে কোন না কোন মামলায় আসামি হয়নি এমন প্রাপ্তবয়স্ক লোক পাওয়া দুষ্কর। তার মামলার ধরণগুলোও বৈচিত্র্যময়। আইন আদালতে দীর্ঘদিন যাতায়াতের ফলে তিনি অনেক বিজ্ঞ আইনজীবীর চেয়েও বেশি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে তিনি অনেক সময় আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। নিজের ঘর আগুনে পুড়িয়ে, নিজের মানুষকে মেরেও তিনি মামলা করেছেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। সাজানো মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জিম্মি করে মানুষের ভিটামাটি দখল করে এবং এরপর মামলা নিষ্পত্তিবাবদ মোটা অংকের টাকা আদায় করে এ বাহিনী। ঢাকার বনশ্রীতে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। গ্রামের বাড়িতে করেছেন অট্টালিকা। পরিবারের সদস্যদের নিশ্চিত করেছেন বিদেশে আয়েশী জীবন।

এ ব্যাপারে শ্রীনগরের বালাশুর গ্রামের প্রবাসী তাছের বেপারী বলেন, আমি ইতালী থেকে ২০১২ সালে যখন দেশে আসি তখন আলেপ বেপারী ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে নান্নূ মুন্সিকে আমার কাছে পাঠায়। আমি চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ক্ষুব্ধ হয়ে নান্নু মুন্সিকে বাদী করে আমি সহ আমার ঘনিষ্ট আরো পাঁচ জনকে আসামী করে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। পরবর্তিতে হয়রানী এড়াতে আলেপ বেপারীকে চাঁদার টাকা দিয়ে ঐ মামলা আপোষ করে ফেলি। কিন্তু দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি আবারো পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। আমি অপারগতা জানালে এবার ছানি মুন্সিকে বাদী করে ঢাকার আদালতে আমার ঘনিষ্ট ও পরিচিত ১১ জনকে আসামী করে একটি চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করে। যার মামলা নম্বর পিটিসন-১৩/২০২১।

জানা গেছে, এলাকাবাসী বেশ কয়েকবার অতিষ্ঠ জনগণের গণধোলাইয়ের স্বীকার হতে হয়েছে আলেপ বেপারীদের। এমনকি আলেপ বেপারীর সহযোগী নান্নুর স্ত্রীর সাথে আলেপ বেপারী আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়লে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী তাকে গণধোলাই দেয়। এছাড়া বালাশুরের জামাইপাড়ায় একবার অতিষ্ঠ মহিলারা ঝাড়ুপেটা করেন। হত্যা মামলায় জেল খেটেছেন অনেক দিন। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোকর কাজে লাগিয়ে বেরিয়ে আসে। গ্রামবাসীর অভিযোগে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাকে পিটিয়ে শ্রীনগর ব্রিজের উপর ফেলে রেখে যায়। দুর্নীতি দমন কমিশনে রয়েছে দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে সব অভিযোগ মিথ্যা ভিত্তিহীন বলে জানান আলেপ বেপারী। বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি অসুস্থ মানুষ- এটুকু বলেই লাইন কেটে দেন তিনি। জানতে চাইলে শ্রীনগর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, আলেপ বেপারী সম্পর্কে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নয়াশতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ