ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইউপি চেয়ারম্যানের ‘নেতৃতে’ অবৈধ বালু উত্তোলন

প্রকাশনার সময়: ০১ অক্টোবর ২০২২, ১৭:১০

কক্সবাজারের রামু উপজেলার চাকমারকুলসহ বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসবে মেতে উঠেছে কুচক্রি মহল। ফসলি জমি ও বাঁকখালী নদীতে নিষিদ্ধ ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হলেও রহস্যজনক কারণে নীরব রয়েছে প্রশাসন। সরেজমিনে দেখলে মনে হবে জলাশয় বা নদী। গভীরতারও মাপকাঠি নেই। যতদূর চোখ যায়; পানি আর পানি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানে দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে চাকমারকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের ছত্রছায়ায় একটি বিশাল সিন্ডিকেট।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, উপজেলায় অন্তত শতাধিক ড্রেজার রয়েছে এখানে। বছরের পর বছর ধরে বালু উত্তোলন করছে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কৃষক। বিলীন হচ্ছে আশপাশের জমি ও বাড়িঘর। এর মধ্যে একশ একর খাস জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ এলাকা নতুন করে ভাঙনের মুখে পড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে সড়ক, মহাসড়ক ও বিদ্যুৎব্যবস্থা। প্রতিবাদ করলে উল্টো প্রাণনাশের হুমকি আসে। চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রশাসন ‘ম্যানেজ’ করার দায়িত্ব নিয়েছেন। তার মালিকানাধীন ১টি ড্রেজারের পাশাপাশি অন্যান্য ড্রেজারগুলোও তার নির্দেশনায় চলছে।

তবে উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চলছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চাকমারকুল ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় সারিবদ্ধভাবে ড্রেজার নদীতে প্রকাশ্যেই বালু উত্তোলন করছে। উত্তোলিত বালু নির্দিষ্ট জায়গায়সহ মহাসড়কের দু’পাশে মজুদ করায় স্থানীয় জনসাধারণের যাতায়তের পাশাপাশি যান চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।

স্থানীয় বাসিন্দা নাজমা বেগম বলেন, ‘আমরা কৃষি জমি ও বাড়ি-ঘর নদীতে হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে সরকারের সাহায্য পেতে চাই না। আমরা চাই সরকার দ্রুত এই অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে আমাদের রক্ষা করুন।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রামুর বিভিন্ন স্থানে গত ৫ বছর ধরে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। কৃষি জমি, নদী ও জলাশয়ে ড্রেজার বসিয়ে প্রতিদিন শত শত ঘনফুট বালু উত্তোলন চলছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব বালু বিক্রি করা হচ্ছে।

রামুর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বারবার এ বিষয়টি তোলা হলেও কেউ কর্ণপাত করছে না। এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃতি ও জলজ পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।’

চাকমারকুল এলাকার কৃষকদের দাবি, এর মধ্যে শতাধিক কৃষক ভূমিহীন হয়েছে। বিল্ডিংয়ে ফাটল দেখা দিয়ে বসবাসের মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এদের হাহাকার কেউই শুনছেন না। এমনই অভিযোগ করেছেন সৈয়দ নুর নামের এক কৃষক। তিনি জানান, খাস জমি এবং মালিকানাধীন আবাদি জমি থেকে জোর করে মাটি ও বালু উত্তোলন করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

অভিযোগ থেকে জানা যায়, চাকমারকুল ইউনিয়নের মিয়াজী পাড়া, নয়া পাড়া, পশ্চিম চাকমারকুল, নতুন চরপাড়া, সালামত পাড়া ও ডেইঙ্গা পাড়া গ্রাম ঘেঁষা বাঁকখালী নদীর আধা কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে আদর মিয়া, কামাল উদ্দিন, ছলিম মিয়া, আমিন সিকদার, শাহেদ, জুয়েল, নাছির উদ্দিন সিকদার, মোহাম্মদ উল্লাহ, মো. সাইয়েদ, জিয়াবুল সওদাগর, মো. সাইফুল ইসলাম, আলা উদ্দীন ও দিদারুল আলমের নেতৃত্বে বাঁকখালী নদীর তলদেশ থেকে দিনরাত বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

জানা যায়, আওয়ামী রাজনীতির ছত্রছায়ায় ভূমিদস্যুরা ‘এন আমল ফিলিং স্টেশনে’র দক্ষিণ পাশের এলাকায় মহাসড়কের সঙ্গে উপসড়ক তৈরি করে খাস জমি এবং মালিকানাধীন ১৭ কানি ফসলি জমির নিচে গভীর ড্রেজিং করে বালু উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে অন্তত ৩শ’ ফুট গভীর হয়েছে ফসিল জমি। প্রশাসনের নাকের ডগায় বালু ও মাটি উত্তোলন করে ‘মেক্স কোম্পানি’র কাছে (রেলওয়ের কাজে ব্যবহৃত) বালু বিক্রি করে শত কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করছে স্থানীয় জিয়াবুল সওদাগর নামের একজন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযুক্তরা বলেন, ‘প্রতিটি ড্রেজারের জন্য ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন। তিনি বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়েছেন মর্মে আমাদের অভয় দিয়েছেন।’ চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় তারা বালু উত্তোলন করে ব্যবসা করছে বলে দাবি অভিযুক্তদের।

চাকমারকুল কোনারপাড়া ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন জানান, ড্রেজারের বিকট শব্দে অতিষ্ট এলাকাবাসী। উচ্চ শব্দ দূষণের কারণে সন্তানদের পড়ালেখা এমনকি ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটছে। এর আগে ড্রেজার মেশিনের বালু তোলার গর্তে পড়ে লম্বরীপাড়ায় ২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, ইজারাদারের অংশীদার হিসেবে ইউএনও তাকে ৪টি ড্রেজার মেশিন বসানোর অনুমতি দিয়েছেন। ড্রেজার বসানোর ইউএনও’র লিখিত কোনো অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা বলেন, ‘অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো হবে।’

নয়াশতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ