ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
সক্রিয় ১৫ চক্র

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে চোরাই গরু ব্যবসায়ীদের মহৎসব

প্রকাশনার সময়: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:৫৪ | আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২১:২৯

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা নাইক্ষ্যংছড়ির ৫টি পয়েন্ট দিয়ে চোরাই পথে প্রতিনিয়ত গরু আসছে দেশে। ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সুবিধাবাদি সদস্যসহ মিলে গরু চোরাচালান নিয়ে তৈরি করেছে বিশাল সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট দিয়ে চলছে জমজমাট মায়ানমারের গরুর ব্যবসার মহৎসব। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এতে সরকার প্রতি মাসে প্রায় কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

মায়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির চলমান সংঘাতকে কেন্দ্র করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে গরু চোরাকারবারির ১৫টি চক্র!

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নাইক্ষ্যংছড়ির পাঁচটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অবৈধভাবে গরু আনছে এ চক্রগুলো। চক্রগুলো সংঘাত শুরুর পর থেকে অবাধে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে চোরাই গরু। প্রতিদিন দুইশ’ থেকে তিনশ’ চোরাই গরু আসছে বাংলাদেশে। এসব চোরাই গরু আসায় স্থানীয় খামারিরা চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এই নিয়ে সীমান্তের পাহারায় নিয়োজিত বাহিনীর তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন, অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সংঘাত শুরু হওয়ার পর গত দেড়মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের আছাড়তলী, ফুলতলী, লম্বাশিয়া, চাকঢালা ও দুইছড়ির পয়েন্টের চোরাই পথ দিয়ে বাংলাদেশে অবৈভাবে গরু প্রবেশ শুরু হয়। প্রতিদিন অবাধে ঢুকেছে শত শত গরু। দৈনিক দুই’শ থেকে তিন’শ গরু ঢুকেছে। এভাবে গত দেড় মাসে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক গরু ঢোকানো হয়েছে।

আছাড়তলী এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জানান, ‘সন্ধ্যা নামলেই চোরাই গরু ঢোকানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাস্তাঘাটে লোকজন কমে গেলে এশার নামাজের পর থেকে এপারে নিয়ে আসা হয় গরুর পাল। এর আগের দিনেই সীমান্তের কাছে এনে জমায়েত করা হয়। এশার নামাজের পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত লাগাতার ঢোকানো হয় গরুর পাল। এক পালে থাকে তিন থেকে ১০টির বেশি গরু।’

লম্বাশিয়া সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, ‘গরু ঢোকানোর সময় এক পালের সাথে কয়েকজন লোক থাকে। তাদের হাতে থাকে নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র। আড়ালে বন্দুকও থাকতে পারে। তারা অনেকটা সশস্ত্র অবস্থায় গরু নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এনে বিচ্ছিন্নভাবে গরুগুলো স্থানীয় বিভিন্ন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে থিতু করে রাখে। পরে সুবিধা মতো বিভিন্ন স্থানে পাচার করে দেয়।’

চোরা কারবারে সক্রিয় ১৫ চক্র:

স্থানীয় লোকজন দাবির করেছেন, এই গরু চোরা কারবারে জড়িতদের প্রায়ই রামুর গর্জনিয়া এলাকার প্রভাবশালী। তারা ওপারের চোরাকারবারিদের সাথে আঁতাত করে অবাধে অবৈধভাবে গরু আনছে। এই অভিযোগ নিয়ে চালানো অনুসন্ধানে স্থানীয়দের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের পাঁচটি পয়েন্টে গরু চোরা কারবারে জড়িত রয়েছে ১৫টি চক্র। এসব চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের দুই ইউপি সদস্য। তারা হলেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জসিম উদ্দীন ও চার নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আরেক জসিম উদ্দীন। এর মধ্যে চার নম্বর ইউপি সদস্য জসিম উদ্দীন ২০২১ সালে কক্সবাজার শহরে ইয়াবাসহ ধরা পড়েছিলেন। একইভাবে ৭নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কালাম ও হাজি পাড়া মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে আরেকটি বড় চক্র। আবুল কালামও ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন।

কচ্ছপিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবু ইসমাঈল মো. নোমাদের ভাই শওকত ও স্থানীয় নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে রয়েছে একটি চক্র। চেয়ারম্যান নোমানকে এই চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন বলে অভিযোগ রযেছে।

এছাড়া হাইস্কুল পাড়ার এক সময়ের দুর্ধর্ষ ডাকাত ফারুক ওরফে কালা ফারুক ও হাবিব আহমদের নেতৃত্বে একটি, হাইস্কুল পাড়ার আমানু সওদাগর, ছুরত আলম ও আবদুর রহিমের নেতৃত্বে একটি, কচ্ছপিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক কবির আহামদ ও হাজী পাড়ার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি, হাজী পাড়ার জয়নাল ও তার ভাই জসিমের নেতৃত্বে একটি, ৮নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আবদু হান্নান ও হাজী পাড়া জসিমের নেতৃত্বে একটি, হাজী পাড়ার মো. আলী, হাশেম ও জামাই এরশাদের নেতৃত্বে একটি, একই এলাকার হাশেম ও তার ভাই ইদ্রিসের নেতৃত্বে একটি, বালুবাসা এলাকার ইউনুছ, হাজীপাড়ার নূরুল আলম ও বালুবাসার যুবলীগ নেতা জসিমের নেতৃত্বে একটি, ডাক্তার কাটার ভিলেজার নূরুল ইসলাম ও পুতুইয়ার নেতৃত্বে একটি, ফুলতলীর মো. ইসলাম, মাহবুবুল আলম ও মিজানের নেতৃত্বে একটি, ফাক্রিকাটার শাহ আলম, হামিদ হোছেন, আবদুল্লাহ ও মো. নূরের একটি এবং বালুবাসার জহির, সুলতান ও নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি চক্র রয়েছে। এসব চক্রের একেকটিতে ১০ থেকে ১৫জন পর্যন্ত জড়িত রয়েছে। এছাড়া বিচ্ছিন্ন আরো বেশ কয়েকজন গরু চোরা কারবারে জড়িত বলে অনুসন্ধানে উঠেছে।

তবে অভিযোগের বিষয়ের অভিযুক্তদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন তারা।

মোড়ে মোড়ে ‘সোর্স’:

চোরা কারবার চক্রগুলো বেশ সতর্ক অবস্থানে থেকেই চোরাই গরু নিয়ে আসছে। সীমান্ত এলাকায় পাহারায় থাকা বিজিবির সদস্যদের চোখ ফাঁকি দেয়াসহ নানা কূটকৌশলে আশ্রয় নেয়। কূটকৌশলের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে চোরা কারবারিদের নিয়োজিত ‘সোর্স বাহিনী’!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সব চোরা কারবার চক্র মিলে অন্তত অর্ধশত ‘সোর্স’ নিয়োজিত করেছেন। যারা নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবি ব্যাটালিয়ান থেকে শুরু করে প্রতিটি মোড় হয়ে একেবারে সীমান্ত পর্যন্ত ছদ্মবেশ নিয়োজিত থাকে। এর মধ্যে কয়েকজন ‘সোর্স’ সার্বক্ষণিক বিজিবি ব্যাটালিয়ানের আশেপাশে ও বিজিবি ক্যান্টিনে অবস্থান করে। তারা বিজিবির বিশেষ অভিযানিক দল বা টহল দলের গতিবিধি অনুসরণ করে। বিজিবি ফোর্স ব্যাটালিয়ান থেকে বের হলেই সাথে সাথে খবর চলে যায় চক্রের কাছে! মূলত এই ‘সোর্স বাহিনী’র প্রধান কাজ হলো বিজিবির অভিযান সম্পর্কে আগেভাগে জেনে নেয়া। এই ‘সোর্স বাহিনী’র তৎপরতার কারণেই বিজিবি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গরু চোরা চালান ঠেকাতে পারে না।

হঠাৎ বিজিবির কড়াকড়ি:

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, দীর্ঘদিন অবাধে চোরাই গরু ঢুকলেও এতদিন বিজিবির কঠোর তৎপরতা ছিলো না। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিতে রাতেই গরু ঢোকায় চোরা কারবারিরা। তবে রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) থেকে বিজিবি সদস্যরা চোরাই গরু প্রবেশ ঠেকাতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। এর মধ্যে সোমবার সকালে এক অভিযানে সাতটি গরুর একটি চালান আটক করেছে। একই সাথে যাতে গরু ঢুকতে না পারে সে জন্য মোড়ে মোড়ে কড়া অবস্থান নিয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। এ কারণে গর্জনিয়া বাজারের সোমবারের সাপ্তাহিক হাটে ৫০টি চোরাই গরু দেখা গেছে। সরেজমিনে বাজারে গিয়ে কথা হলে এক চোরা কারবারি এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, বিজিবির কড়াকড়ি না হলে এই দিন হাজারের বেশি চোরাই গরু উঠতো গর্জনিয়া বাজারে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্তমানে কয়েক হাজার চোরাই স্থানীয় বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে। বিজিবির কড়াকড়ি বাড়লে গরুগুলো নানাভাবে লুকিয়ে রেখেছে চোরা কারবারিরা। অনেকে ঘরের কক্ষে লুকিয়ে রেখে বাহির থেকে তালাবদ্ধ করে রেখেছে।

লোকসানের মুখে স্থানীয় খামারিরা:

দেশীয় খামারিদের উন্নয়নের তাগিদেই সরকার গরু আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ চোরাই পথে গরু প্রবেশ করায় ব্যাপক সংকটের মুখে পড়েছেন রামুর গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, ঈদগড় এবং নাইক্ষ্যংছড়ির খামারিরা। কারণ এসব এলাকা কেন্দ্রিক পাইকারি গরুর বিক্রির বড় হাট গর্জনিয়ার বাজারটি। অর্ধশত বছরের পুরনো বাজারটিতে কক্সবাজারের প্রত্যন্ত এলাকা এবং চট্টগ্রামসহ দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারিরা গুরু কিনতে আসে। কিন্তু চোরাই হয়ে আসা অধিকাংশ গরু এই বাজারে উঠানো হচ্ছে। এতে হঠাৎ গরুর দরপতন হয়েছে।

বাজারে কথা হলে স্থানীয় খামারি আবুল বশর বলেন, ‘আমি দুটি গরু তুলেছি। দুটি গরু পাইকারি দাম হাঁকিয়েছেন এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। অথচ এই দুই গরুর স্বাভাবিক এক লাখ ৬০ হাজারের উপরে থাকে। চোরাই পথে আসা গরুগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে কম দামে পাচ্ছে। তাই স্থানীয় গরু বিক্রি কমে গেছে।’ একই কথা জানিয়েছেন অনেক স্থানীয় খামারিরা।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল মো. রেজাউল করিমকে বেশ কয়েকবার মুঠোফোনে কল করা হয়। কিন্তু কল না ধরায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

তবে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে গরু প্রবেশে আমরা কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি। অভিযানে গরুর চালান আটক করে নিলামে তোলা হয়েছে। গরু চোরা চালান বন্ধের জন্য বিজিবিকে কঠোর হতে বলেছি। তবুও গরু প্রবেশ বন্ধে আরো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ