ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মধু উৎপাদনে স্বাবলম্বী খুলনার আবুল কালাম

প্রকাশনার সময়: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৭:৫৮

প্রতি মৌসুমে প্রায় ২শ’ মণ মধু উৎপাদন করছেন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের আবুল কালাম সরদার (৫৮)। বর্তমানে তার উৎপাদিত মধু দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এতে বছরে তার মুনাফা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। সফলতার জন্য পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও।

এদিকে, মধু চাষে আবুল কালাম একাই লাভবান হচ্ছেন না, অন্যদেরকেও স্বাবলম্বী করতে গড়ে তুলেছেন ‘খুলনা মৌ-চাষী কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে একটি সংগঠনও। এ সংগঠনে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ৩৫ সদস্যের প্রত্যেকেই করছেন মৌচাষ। আবুল কালাম তাদেরকে মৌমাছি পালন, মধু উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সকল কৌশল হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দামোদর গ্রামের মৃতঃ আকাম সরদারের পুত্র আবুল কালাম সরদার বিসিক থেকে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন বিষয়ক ২মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে মৌমাছিসহ একটি বাক্স প্রদান করা হয়। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পিতার ছোট্ট মুদি দোকানে তাকে সময় দিতে হয়। ফলে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে ২০০২ সালে বিসিক থেকে ২৮হাজার টাকা দিয়ে ১১টি বাক্স অর্থাৎ ৩৩টি ফ্রেম মৌমাছিসহ ক্রয় করেন। প্রথম বছর মধু মৌসুমে ৬০হাজার টাকা লাভ হয়। পরের বছর আরও ৩৫ বাক্স তৈরি করে মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদনে নেমে পড়েন। সেবারও লাভের পরিমাণ ছিল লক্ষাধিক টাকা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বর্তমানে এসে ২৫০বাক্সে ফ্রেম সংখ্যা দাড়িয়েছে আড়াই হাজারে। বার্ষিক মধু উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২শ’ মণ।

মৌচাষি আবুল কালাম সরদার জানান, মধু মৌসুম শুরু ডিসেম্বর মাসে, চলে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। বিভিন্ন ফুলের মৌসুম বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে। সরিষা ফুলের মৌসুম ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। এটি পাওয়া যায় সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, জামালপুর ও কুড়িগ্রামে। ধনিয়া ফুলের মধু সংগ্রহ করতে হয় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এবং কালো জিরা ফুলের মধু ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে শরিয়তপুর, ফরিদপুর, ও রাজবাড়ি থেকে। লিচু ফুল মার্চ মাসে ঢাকা, গাজীপুর, পাবনা, নাটোর, দিনাজপুর ও যশোর থেকে। মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত সুন্দরবন সাতক্ষিরা রেঞ্জের শ্যামনগর, বুড়িগোয়ালিনি থেকে গোলাখালি পর্যন্ত খোলপেটুয়া নদীর এপারে মৌমাছির বাক্স রেখে অবস্থান করতে হয়। সুন্দরবন কেন্দ্রীক পর্যায়ক্রমে খলিসা ফুল, গরান, কেওড়া ও বাইন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ হয়ে থাকে। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সাতক্ষীরা, কলারোয়া এলাকায় বরই ফুল থেকে কিছু মধু সংগৃহিত হয়। বছরের বাকি ৬মাস মৌমাছিকে তোলা খাবার হিসাবে চিনি ও বিগত মছরের মধু খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এ সময় নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও কুমিল্লা এলাকায় বিভিন্ন ধরণের সবজি ও ধনিয়া ফুল থেকে কিছু মধু সংগ্রহ করে। সেটিও মৌমাছির খাদ্য।

তিনি জানান, মৌমাছির বড় শত্রু ফিঙে রাজা, সুইচোরা পাখি ও ভিমরুল। এরা মৌমাছি ধরে খায়। সেক্ষেত্রে গুলতি দিয়ে ফিঙে দমন, জাল পেতে সুইচোরা এবং বাসা পুড়িয়ে দিয়ে ভিমরুল দমন করতে হয়। ৫ ফ্রেমের ১ কলোনিতে ১টা রাণি মাছিসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুরুষ ও শ্রমিক মৌমাছি থাকে। এর দাম ২৫শ’ টাকা এবং ফ্রেমের মূল্য ১৫শ’ টাকা মোট ৪ হাজার টাকা। বাক্স প্রতি এক মধু মৌসুমে ১ থেকে দেড় মন মধু উৎপাদিত হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি মাছি ১হাজার ফুল পরিভ্রমণ করে এক ফোটা মধু তৈরিন করে। আবার ফুল থেকে সংগৃহিত মধুর মাত্র ২০ভাগ মধু উৎপাদিত হয়। চাষের মাছির গড় আয়ু ৪২দিন। জন্মের প্রথম ২১দিন বাক্সে থেকে কর্মক্ষম হয়। জীবনের বাকি ২১দিনে চা চামচ মধু সংগ্রহ করে।

সফল মৌ-চাষি আবুল কালাম বলেন, বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ফুল থেকে সংগ্রহকৃত মধুর রং, স্বাদে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে দামও ভিন্ন। ‘সলিড মধু’ নামে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সরিষা ফুলের মধুর খুচরা মুল্য কেজি প্রতি ৩শ’ টাকা, লিচু ফুলের ৩৫০টাকা, সুন্দরবনের মধু ৫শ’ টাকা, ধনিয়া ফুলের ৩শ’ টাকা, কালো জিরা ১হাজার টাকা, বরই ফুল ৩শ’ টাকা।

তিনি জানান, গত মৌসুমে তার উৎপাদিত ২শ’ মন মধুর গড় ২৫০টাকা কেজি হিসাবে পাইকারি মুল্য ছিল প্রায় ২০লাখ টাকা। এর মধ্যে ৬জন কর্মচারীর বেতন, ভরণপোষণ বাবদ ৭লাখ ২০হাজার টাকা, পরিবহন বাবদ খরচ ২লাখ টাকা এবং খাবারসহ মৌমাছি পালন ৩লাখ টাকা, স্থান ম্যানেজে ১লাখ টাকা ও আয়কর প্রদানসহ খরচ পড়ে ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। ফলে তার নীট মুনাফা ছিল ৬লাখ ৮০ হাজার টাকা। তার উৎপাদিত মধু দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এখন দেশের বাইরে সৌদি, কাতার, কুয়েত এ রপ্তানি হচ্ছে। এ অঞ্চলের মধু মানসম্মত ও দামে কম হওয়াতে চোরাইপথে ভারতে পাচার হচ্ছে, এছাড়া দেশে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও সুষ্ঠু বাজারজাতের ব্যবস্থা না থাকায় স্বল্প মূল্যে বিদেশে রপ্তানি করতে হয়।

মৌচাষী আবুল কালাম সরদার ২০১৯ সালের ১১ মার্চ রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় আকামু গিয়াস উদ্দিন মিল অডিটরিয়ামে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মীর নুরুল আলমের হাত থেকে জাতীয় মৌ মেলা-২০১৯ এ সফল মৌ- চাষি আবুল কালাম সরদার পুরস্কার লাভ করেন। তার পুত্র মোঃ হাসানুল বান্না বিএল কলেজের মাষ্টার্স পাশ করেন। তিনি মৌচাষে দক্ষতা অর্জন করায় বিসিক, যুব উন্নয়ন ও সমবায় অধিদপ্তরের প্রশিক্ষক হিসাবে বিভিন্ন কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ