‘সগারি (সবার) ভাগ্য বদলে (বদলায়), খালি হামার ভাগ্য বদলে না। হামার ভাগ্য দিনে দিনে আরও খারাপ হয়, হামার দুঃখ-কষ্ট বারোমাস ধরি চলে। হামার মতো কামলা-কিষাণের কষ্ট দেখার কেউ নাই’ –অনেকটা আক্ষেপ করেই কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের কৃষক মমতাজ আলী।
তিনি আরো বলেন, ‘এবার শুধু নিজেদের ও গরুর খাবারের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই আবাদ করমো, এর একনা বেশি জমিও আর আবাদ করবের নই।’
মমতাজ আলীর মতো আরেক চাষি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নের কৃষক জয়নাল মিয়া। তিনি জানান, বিগত আমন মৌসুমে প্রতি বিঘা জমি একবার চাষের জন্য দিয়েছেন ১৮০ টাকা। হঠাৎ ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকা হওয়ায় হালচাষের দাম বাড়িয়েছে পাওয়ার টিলার মালিকরা। প্রতি বিঘায় এক চাষের মূল্য ২৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করে নিচ্ছে।
নদী বেষ্টিত গাইবান্ধায় প্রতিবছরই বোরো ধানের আবাদে বাম্পার ফলন হয়। তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, সারের অব্যাহত দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট, সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত মূল্যে প্রান্তিক কৃষকদের ধান বিক্রি করতে না পারা, উৎপাদন খরচ না ওঠাসহ নানান প্রতিকূলতার কারণে এ বছর আমন ধান চাষে কৃষকদের তেমন আগ্রহ নেই। উল্টো তাদের কণ্ঠে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ আর হতাশা।
গত মৌসুমেও গাইবান্ধায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালো ফলনে কৃষকরা খুশি হলেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত তাদের মুখে হাঁসি ফোটেনি। এরই মধ্যে নতুন করে জ্বালানি তেল ও সারের দাম বৃদ্ধি, কৃষকের উপর এ যেন ‘মরার উপর খরার ঘাঁ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সদর উপজেলার আনালেরতারি গ্রামের কৃষক ফয়জার মিয়া জানান, আষার-শ্রাবণ মাসে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় এবার বেশিরভাগ কৃষক সেচনির্ভর হয়েছেন। সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, আবার শ্রমিক সংকটও ভোগাচ্ছে তাদের। নতুন করে আবার ডিজেল ও ইউরিয়া সারের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কৃষকদের। এ অবস্থায় তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার আমন মৌসুমে এক বিঘা জমিতে খরচ হবে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে ইউরিয়া সার ও ডিজেলের দাম অন্যতম। এ ছাড়া শ্রমিক, হালচাষ ও চারা রোপণ করতে ৩ হাজার ২০০ টাকা এবং সেচ বাবদ খরচ হবে ১৮শ’ টাকা। এরপর নিড়ানি, কীটনাশকসহ শ্রমিকের মজুরি, কাটা-মাড়াই করতে আরও ৩ হাজার টাকা খরচ হবে বিঘা প্রতি। অর্থাৎ এবার সার, সেচ ও হালচাষে বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে প্রায় ২ হাজার টাকা থেকে ২৫শ’ টাকা। বিঘায় ধানের উৎপাদন হবে জমির মাটি ভেদে ১০ থেকে ১৫ মন পর্যন্ত।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধা জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার পাল বলেন, ‘বর্তমান সরকার কৃষি বান্ধব। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বিক্রেতারা যেন সারের দাম বেশি নিতে না পারে, এজন্য কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতার কারণে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কিছুটা বিপাকে পড়েছেন কৃষক।’ তবে এ সমস্যা দ্রুতই নিরসন হবে বলেও জানান তিনি।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমন ধান অনেকটাই বৃষ্টি নির্ভর। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ার কারণে কৃষকদের শ্যালো ইঞ্জিনের সাহায্যে জমিতে চারা রোপণ করতে হচ্ছে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পাবে।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ