জন্মগতভাবে দুই হাত অচল সুরাইয়া জাহানের। ভাষাও তেমন স্পষ্ট নয়। তাকে চোখের ইশারায় ভাববিনিময় করতে হয়। অপর শারীরিক প্রতিবন্ধী সৈকত খানের গল্পটাও প্রায় এক রকমের।
ওদের স্বপ্নের জানালার পরিধি কতটুকুই বা বিস্তৃত? তবে আর দশটা মানুষের মতো ওদেরও স্বপ্ন আছে। ওরাতো স্বপ্ন দেখতেই পারে। কিন্তু ওদের স্বপ্নের জানালার ফুটো দিয়ে আর কতটুকু আলোই বা পৌঁছায়? কতটুকু আলো ওদের স্পর্শ করতে পারে? তবু দমে যায়নি সুরাইয়া-সৈকতের স্বপ্ন। বুকভরা দম নিয়ে নেমে পড়ে মাঠে। নিরন্তর প্রচেষ্টায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে মাড়িয়ে সুরাইয়া-সৈকত এগিয়ে যাচ্ছে।
পরিবারের অনুপ্রেরণায় এবং নিজেদের অদম্য ইচ্ছায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি শেষ করে এবার অংশ নিয়েছেন গুচ্ছভিত্তিক ‘বি’ ইউনিটের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায়।
শনিবার (১৩ আগস্ট) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা দেন সুরাইয়া ও সৈকত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সরকারি চাকরি করে পরিবারের হাল ধরার স্বপ্ন তাদের।
তারপরেও সুরাইয়া-সৈকতের মনে কষ্ট। কারণ তারা ইচ্ছে থাকলেও সহপাঠীদের সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে পারে না। দৌঁড়াতে পারে না।
অদম্য সুরাইয়ার বাড়ি শেরপুর সদরের আন্দারিয়া সুতিরপাড় এলাকায়। তার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া। প্রথমবার কোথাও ভর্তির সুযোগ না পেয়ে পড়াশোনার প্রবল আগ্রহ থেকে দ্বিতীয়বার গুচ্ছতে অংশ নিয়েছেন সুরাইয়া। পরীক্ষায় লিখেছেন পা দিয়ে। সুরাইয়ার বাবা ছফির উদ্দিন চরপক্ষীমারি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। মা মুর্শিদা গৃহিণী। তিন সন্তানের মধ্যে বড় ও ছোট দুই সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধী।
মা মুর্শিদা বলেন, চলতে-লিখতে না পারা আমার বড় মেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। তাই আমরাও চেষ্টা করি যতটা ভালো রাখা যায়। এই লড়াই করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে আমাদের খুশির শেষ থাকবে না। তবে সুরাইয়ার ইচ্ছা কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। এখানে ভর্তি হতে পারলে আমাদের জন্যও ভালো ছিল।
পা দিয়ে লিখেই সুরাইয়া চরকান্দারিয়া হাইস্কুল থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে এসএসসিতে ৪.১১ এবং শেরপুর মডেল গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসিতে ৪.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
অপরদিকে শারীরিক অক্ষামতার জন্য পরিবার-স্বজন ও প্রতিবেশিরা তার পড়াশোনা নিয়ে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করলেও সৈকতের কখনো মনে হয়নি সে পারবে না। কিন্তু শারীরিকভাবে ভিন্ন হওয়ায় বন্ধুদের কাছে ছিলেন অগ্রহণযোগ্য। তবে বাবার অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন এবার। বাবা সবুজ খানের সঙ্গেই সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা থেকে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে। সে সময় অনেকেই তাকিয়ে দেখেছেন অদম্য সৈকতের মনের জোর।
হতদরিদ্র কৃষক সবুজ খানের তিন সন্তানের দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। কৃষিকাজ থেকে আসা অর্থ দিয়েই সন্তানের স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখা করাতে চান দরিদ্র এই কৃষক বাবা। সৈকত সুনামঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার জনতা মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পান ৩. ৫০ এবং ধর্মপাশা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ৩.৫৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এবার কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।
সৈকতের বাবা সবুজ খান বলেন, ছেলেটার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা কথা চিন্তা করে তাকে পড়াশোনা করিয়েছি। আমার কষ্ট হলেও সব সময় পড়াশোনার খরচ যুগিয়ে এসেছি। আমি চাই সে যেন ভালো থাকে।
নিজের জীবনের স্বপ্ন কী জানতে চাইলে বেশ লজ্জা পায় সৈকত। স্বপ্ন যদি পূরণ না হয়- এমন আশঙ্কায় বলতে চায়না নিজের স্বপ্ন। মুখেটিপে হেসে হেসে বলে, আমি অনেক কিছুতে অক্ষম হলেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। সব বাধা অতিক্রম করে এই পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেনো চান্স পাই সকলের কাছে সে দোয়াই প্রত্যাশা করি। আপাতত এটুকুই স্বপ্ন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের আমরা নিয়ম অনুযায়ী সহযোগিতা করেছি। তারা যেন তারা ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারে সেদিকে খেয়াল রেখেছি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তাদের অতিরিক্ত সময়ও দেয়া হয়েছে।
গুচ্ছ পদ্ধতিতে ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে আসন পড়ে ৭ হাজার ৭৮৩ জনের। তবে অংশ নেয়নি ৭০১ জন পরীক্ষার্থী। পরীক্ষায় উপস্থিতির হার ৯১ শতাংশ।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ