ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
ম্যানেজিং কমিটি গঠনে প্রধান শিক্ষকের নজিরবিহীন স্বজনপ্রাীতি

অনিয়মের আখড়া খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়

প্রকাশনার সময়: ১১ আগস্ট ২০২২, ০০:১৪ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২২, ১৫:২০

তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্কুল পরিচালনা করা যার দায়িত্ব। কিন্তু তিনিই কিনা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায়। বলছি কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহিরুল হকের কথা। তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এরই মধ্যে গড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তর পর্যন্ত।

অভিযোগ রয়েছে, যথাসময়ে অডিট না করা এবং ম্যানেজিং কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা ও বির্তকিত নানা সিদ্ধান্তের কারনে বিদ্যালয়টি এখন অনিয়ম আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। এ কারনে ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্টানটির সুনাম নষ্ট হতে বসেছে।

জানা গেছে, আগামী ২০ আগস্ট বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে তপশীল নাটকীয়ভাবে নিজের স্ত্রীকে মহিলা অভিভাবক সদস্য মনোনীত করা। অথচ তিনি আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্টানের এমপিওভুক্ত শিক্ষিকা। এছাড়াও গোপনে দাতা সদস্য সৃজন এবং নিজের পছন্দের শিক্ষকদের দিয়ে কমিটি গঠনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিদ্যালয়ের বিতর্কিত প্রধান শিক্ষক জহিরুল হক। পাতানো নির্বাচন আয়োজনে বিদ্যালয়ের ভোটারদের সরকারি তালিকার পাশাপাশি আরো একটি ভুয়া তালিকা করেছেন বলেও অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন।

স্থানীয়দের দাবি, খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়টি কক্সবাজার সদরের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পুঁজি করে জহিরুল হকের ‘লালিত’ এডহক কমিটির সহযোগীতায় প্রধান শিক্ষক নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

জামায়াত-শিবিরের আখড়া খ্যাত বিদ্যালয়টিতে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য চরম আকার ধারন করেছে। অংকের সাগর হিসেবে পরিচিত সনজিত শর্মা নামের একজন শিক্ষক প্রতিষ্টানটির শুরু থেকে খেয়ে না খেয়ে শিক্ষকতা করে আসছেন। নির্বাচিত কমিটি সনজিতকে বার বার সহকারি প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তাকে নিয়োগ দিতে অনিহা জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক জহিরুল হক। বর্তমানে সহকারি প্রধান শিক্ষক পদটি শুণ্য থাকায় প্রধান শিক্ষকের ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে শুণ্য পদটি পুরন করার চেষ্টায় মগ্ন রয়েছেন বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, হিন্দু শিক্ষকদের ব্যাপক মানসিক নির্যাতন করা হয়। তাদের কখনো ম্যানেজিং কমিটিতে রাখেনি প্রধান শিক্ষক। সবচেয়ে প্রবীণ এই শিক্ষক সনজিত শর্মার কাছ থেকে নবম-দশম শ্রেণীর ক্লাসগুলো কেড়ে নেওয়া হয়।

বিদ্যালয়েটির প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘১৯৯৩ সালে এলাকার কিছু বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি এলাকায় শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় ও প্রবাসী দানশীলদের সহযোগিতায় বিদ্যালয়টি দিনেদিনে উন্নতি লাভ করে। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাবেক সভাপতি এনামুল হকের নেতৃত্বে শিক্ষা ও অবকাঠামোগতভাবে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। যার সুনাম দ্রুত ছড়ায় জেলায়। এরপরে লোভ পড়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়ন্ত্রিত একটি সিন্ডিকেটর। যার কারণে শিক্ষকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মনোমালিন্য ও দ্বন্দ্ব। অনেক দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যার প্রভাব পড়ে পাঠদানে। এরই ফলে বিগত তিন বছর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে চরম বিপর্যয় ঘটে।’

তিনি আরো জানান, আসন্ন ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনেও প্রধান শিক্ষক স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের মাধ্যমে দূর্নীতির রামরাজত্ব অব্যাহত রাখার জন্য তথাকথিত ব্যক্তিদের দিয়ে পরিকল্পিত ও সাজানো কমিটি গঠনের ছক চূড়ান্ত করেছেন। অতীতে কোন কমিটি এভাবে হয়নি। মনে হয়, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অনিয়মকে ঢাকার চেষ্টা হিসেবে এভাবে কমিটি করা হচ্ছে। এলাকাবাসীর উচিত বিদ্যালয়ে অনিয়মের ডালপালা আরো ছড়িয়ে পড়ার আগেই সমস্যা নিরসনে সোচ্চার হওয়া। তা না হলে বিদ্যালয়ে কেবল ভবনই থাকবে, মানসম্মত পাঠদান হবে না। চলবে অর্থের হরিলুট আর পরিচালনা কমিটির স্বজনপ্রীতি।

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রধান উদ্যোক্তা ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ জানান, তিনি এ পর্যন্ত বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য গঠিত ৫টি কমিটিতে ছিলেন। তিনি করোনা পূর্ববর্তী একটি কমিটি কর্তৃক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়নসহ পর্ষদের সার্বিক ভূমিকায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করলে ও অবশিষ্ট ৪টি কমিটির দায়িত্বপালনে অনেক ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন। বিশেষ করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহিরুল হক আগমনের সময় হইতে এ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় হিসাব নিকাশ সঠিকভাবে কখনো উপস্থাপন করেননি। এমনকি বিদ্যালয় কমিটির অনেক সদস্য জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক হিসাব পরিচ্ছন্ন আছে কিনা বা এ সংক্রান্ত সকল বিষয় তিনি (প্রধান শিক্ষক) জানেন না বলে জানান। হিসাব প্রদানে প্রধান শিক্ষকের সদিচ্ছার অভাবে রয়েছে বলে জানান তিনি।

কমিটির সাবেক নেতারা জানান, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে মো: আলম নামের একজন জামায়াত নেতাকে সহকারি প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চালায় প্রধান শিক্ষক জহির। বিষয়টি আচ করতে পারে তৎকালীর কমিটি। তখন তার নিয়োগটি বাতিল করে পুরো পদটি শুণ্য ঘোষনা করে পরিচালনা পষদ। সম্প্রতি প্রধান শিক্ষক তাকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এমনকি সর্বশেষ কমিটির দায়িত্ব শেষ হলেও প্রধান শিক্ষক হিসাব দেননি। হিসাবের ব্যাপারে পুরো কমিটি প্রধান শিক্ষককে চাপ প্রয়োগ করলেও প্রধান শিক্ষক বিভিন্ন টাল-বাহানায় দেড় বছর পার করে দেন। পরে করোনাকালীন লকডাউনে এডহক কমিটি চলে আসায় আর হিসাব দেয়ার মতো জবাবদিহিতায় পড়তে হয়নি প্রধান শিক্ষককে। যার ফলে অনিয়মের বিষয়টিও চাপা পড়ে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে প্রতি দশবছর পর বিদ্যালয় অডিট করা হয়। ইতিপূর্বে আসা একটি অডিট টিম নিম্ন মাধ্যমিক থাকা অবস্থায় মাধ্যমিকের বেতন তোলায় প্রধান শিক্ষককে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে। যা গত অডিট কমিটি হাতে করে নিয়ে আসে। প্রতিবার প্রধান শিক্ষক তার আঙ্গাবহ শিক্ষকদের নিয়ে লোক দেখানো অডিট সম্পন্ন করে। কিন্তু গতবার নির্বাচিত কমিটির ২ জনসহ একজন শিক্ষককে অডিটের দায়িত্ব দিলে প্রধান শিক্ষক আজ কাল বলে কাল ক্ষেপন করে কমিটিকে বিদায় দিয়ে কৌশলে এডহক কমিটি নিয়ে আসে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, ‘একবার পরিচালনা পরিষদ আমাকে অডিটের দায়িত্ব দেন। অডিট করতে গিয়ে চোখে পড়ে প্রধান শিক্ষককের অসংখ্য অনিয়ম, স্কুলের টাকা নিয়ে নয়ছয় ও নানা অসংগতি। তখন বিভিন্ন কাগজপত্রের অনিয়ম নিয়ে প্রধান শিক্ষককে প্রশ্ন করা হলে তিনি এইসব বিষয় এড়িয়ে যেতে অর্থাৎ ধামাচাপা দিয়ে অডিট শেষ করতে হাতে পায়ে ধরেন। তখন প্রধান শিক্ষক জহির আমাকে বলেন, এখন দয়া করে আমার ইজ্জত রক্ষা করেন, এসব কাগজপত্র আমি পরে ঠিক করে রাখবো।’

একাধিক অভিভাবক ও শিক্ষকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের এসব অনিয়মে মূল সহায়তাকারি হিসেবে কাজ করের অফিস সহকারি নুরুল হক। তার মাধ্যমে বিদ্যালয়ের নষ্ট জিনিস ও বই খাতাপত্র রাতের আধাঁরে বিক্রি করেন প্রধান শিক্ষক। লোক দেখানোর জন্য অবশিষ্ট অল্প কিছু দিনে বিক্রি করা হয়। চুরির এসব ঘটনা ধরা পড়লেও প্রধান শিক্ষক তাদের কোন শাস্তির ব্যবস্থা করেন না। উল্টো তাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে যান। অনিয়মের অন্যতম হোতা নুরুল হক ইতিপূর্বে চাকরি ছেড়ে সৌদি আরব চলে যান। কিন্তু ৪ বছর পর ফিরে আসলে তাকে আবারও চাকুরীতে যোগদানের সুযোগ দেন প্রধান শিক্ষক। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয় পরিচালনার নামে এসব অনিয়মে নানা কুটকৌশল ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন প্রধান শিক্ষকের চাচাতো ভাই ওবায়েদ।

এব্যাপারে জানতে চাইলে খরুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, নিজের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, নির্বাচিত কমিটির সময়ে অডিট রিপোর্ট দেয়া সম্ভব না হলেও পরে হিসাব সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ছাড়া আসন্ন কমিটি মহিলা অভিভাববক সদস্য হিসেবে নিজের স্ত্রীকে মনোনয়ন দেয়া প্রসংগে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী হলেও তিনি এ বিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক। তাই মহিলা অভিভাবক সদস্য হওয়ার অধিকার তার রয়েছে। এজন্যই তার স্ত্রী ফরম নিয়েছেন। এতে অনিয়মের কিছু নেই।’ নির্বাচনে দুই ধরনের ভোটার তালিকা প্রসংঙ্গে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সরকারি তালিকাতে ঠিকানা দেয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু প্রার্থীরা যাতে ভোটারদের চিনতে পারে, সেজন্য ঠিকানা সহ আরও একটি তালিকা করা হয়েছে।’

ভূক্তভোগীদের অভিযোগ ইতিপূর্বে এ বিদ্যালয়ে অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে একজন অভিভাবককে রশি দিয়ে বেঁধে পিঠিয়েছিলেন বিদ্যালয়টি প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্যরা। ওই ঘটনায় পুরো জেলায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ওই ঘটনায় প্রধান শিক্ষক সহ অনেকে কারাভোগ করার পরও এখনো বিদ্যালয়টি অনিয়ম বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং বেড়েছে অনিয়মে জড়িতদের আস্ফালন আর অদৃশ্য ক্ষমতার দাফট।

এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, তিনি সম্প্রতি যোগদান করেছেন। সময়ের অভাবে শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোর দিকে নজর দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিষয়টি এখন জেনেছেন, এ ব্যাপারে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ