কখনো হাতে কোদাল নিয়ে মাঠে কিংবা ক্ষেতে লাঙ্গলের ফলা ধরে চাষ, কখনোবা পোলট্রিতে মুরগির খাবার ও পানি দেওয়া, কখনোবা হাঁসের দেখাশোনা, খাবার সহ নানান কাজে ছুটে চলা এক অদম্য মেয়ের পথ চলা। সাংসারিক সব কাজকর্ম করে নির্দিষ্ট সময়েই আবার কলেজে ক্লাশের উদ্দেশ্যে ছুটে চলা। দৈনন্দিন জীবনে এমনই এক রুটিনে বেঁধে চলছে এক কলেজছাত্রীর জীবনের গল্প। অজপাড়া গাঁয়ে প্রযুক্তির বিকাশে মোবাইলে ইউটিউব দেখে দেখে গড়ে তোলেন হাঁস-মুরগির খামার। হাঁস-মুরগির যে কোন সমস্যা দেখা দিলে সাথে সাথে ইউটিউব দেখে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও কর্মের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় যেন প্রাণবন্ত এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের প্রতিচ্ছবি কলেজছাত্রী দিলরুবা ।
তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের রামেশ্বরপুর গ্রামে। পিতা হেলাল উদ্দিন। দিলরুবা হোসেনপুর সরকারি পাইলট কলেজ থেকে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। সে অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমতি মেয়ে।
তিন ভাই বোনের মধ্যে দিলরুবা সবার বড়। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় অভাব অনটনের সংসারে গড়ে তুলেছেন এক মুরগির খামার। নিজে কাঁদে মাটি তুলে টিন সেট ঘর নির্মাণ ও মুরগির সেটসহ যাবতীয় সবকিছু তৈরি করেছেন। গেল বছর এক হাজার ব্রয়লার মুরগি নিয়ে যাত্রা শুরু। এরই পাশাপাশি দুইশো হাঁস পালন শুরু করেন দিলরুবা। পোলট্রি খামারে মুরগির দেখাশোনা, খাওয়ানো, ঔষধপত্র সবই নিজ হস্তে করেন সে। আবার লেখাপড়ায় পিছিয়ে নেই দিলরুবা। কাজের ফাঁকে একটু সময় পেলেই টেবিলে পড়তে বসেন। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। তাই পড়ার চাপ বেশি। তবুও থেমে নেই তার পথচলা। লেখাপড়ার পাশাপাশি মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে তিল তিল করে করে তুলেছে মুরগির খামার ও হাঁস পালন। ইতোমধ্যে হাঁস ডিম দিতে শুরু করেছে। পোলট্রিতে প্রতিদিন দুই বস্তা খাবার পানিসহ খরচ হয় ৬০০০ টাকা। প্রতিমাসের আনুষাঙ্গিক ব্যয় মিটিয়ে বাড়তি উপার্জন হচ্ছে তার। এ দিয়ে সংসারে খরচ ও লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন দিলরুবা। তার কাজে বাবা হেলাল উদ্দিন সাহায্য ও অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন। এলাকায় দিলরুবা এখন অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেকে একজন স্বাবলম্বী করে তুলতে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তা দিয়ে এলাকায় সুনাম ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন তার খামার ও তাকে দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোকেই ছুটে আসছেন।
দিলরুবা বলেন, মহামারি করোনায় কলেজ বন্ধ থাকা অবস্থায় ইউটিউব দেখে মুরগির খামার গড়ে তোলার ইচ্ছে পোষণ করি। কৃষি কাজ ও হাঁস-মুরগি পালন করা আমার কাছে অত্যন্ত ভালো লাগে। এত কাজের চাপেও আমার লেখাপড়ার কোন ক্ষতি হচ্ছে না।আমার আর্থিক অবস্থা এবং পোলট্রি খামার দেখে এলাকার অনেক বেকার ছেলে পোলট্রি ও গবাদি পশুর খামার করে তারাও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সে বলেন, সহজ শর্তে কোন ব্যাংক-বীমা কিংবা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঋণ প্রদান করলে আগামীতে একটি হ্যাচারি ও বড় মাপের গবাদি পশুর খামার স্থাপন এবং খামারটি আরও বেশি প্রসারিত করতে চাই। একই সঙ্গে এলাকার বেকার ছেলেদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার ইচ্ছে রয়েছে। দিলরুবা আরো বলেন, চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে না ঘুরে পোলট্রি খামার করে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। এতে বেকারত্ব ঘুচবে এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তিনি শিক্ষিত বেকার যুবকদের পোলট্রি খামার করার আহ্বান জানান।
স্থানীয় লোকজন বলেন, দিলরুবা একজন কঠোর পরিশ্রমী ও নারী উদ্যোক্তা। তার পরামর্শ ও সহযোগিতায় এলাকার অনেক বেকার যুবক-যুবতী পোলট্রি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। এ খামারি দেশের মুরগি ও ডিম চাহিদা পূরণ করছেন। সেই সঙ্গে পুষ্টিরও যোগান দিচ্ছেন
হোসেনপুর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা: আব্দুল মান্নান বলেন, দিলরুবা লেখাপড়ার পাশাপাশি পোলট্রি খামার করে এখন একজন মডেল খামারি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। পোলট্রি খামার করে কিছুটা হলেও দেশের মুরগি ও ডিমের চাহিদা পূরণ করছেন। সেই সঙ্গে পুষ্টির যোগানও দিচ্ছেন। সঠিক পদ্ধতিতে পোলট্রি খামার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার দেখাদেখি ওই এলাকার যুবক-যুবতির মধ্যে পোলট্রি খামারের প্রতিযোগিতা চলে এসেছে। দিলরুবা এভাবে তার পোলট্রি খামারের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলে আগামীতে আরও ভালো করবে বলে আশা করছি।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ