কক্সবাজার শহরের বড় বাজারে বুধবার সকালে রুপালি ইলিশ কিনতে এসেছেন টেকপাড়া এলাকার কামরুল এহেসান। ইলিশের দামে চরম ক্ষুব্ধ এই ক্রেতা বুধবার (২৭ জুলাই) সকালে বলেন, টিভির খবরে দেখাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে। দামও কম। অথচ বাজারে ইলিশ কিনতে এসে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। বিভিন্ন আকৃতির ইলিশের দাম আগের মতোই চড়া। সাড়ে ৫শ’ টাকা দিয়ে ১ কেজি গরুর মাংস কেনা গেলেও ১ কেজি ওজনের ইলিশ কিনতে ১ হাজার ৪শ’ টাকা গুণতে হচ্ছে। সেহিসেবে ২ কেজি গরুর মাংসের টাকায়ও মিলছে না ১ কেজি ইলিশ।
এদিকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর থেকে বঙ্গোপসাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে ইলিশ। শুরু হয়েছে ইলিশের ভরা মৌসুম। সাগরে প্রতিদিন ধরা পড়ায় বাজারে সরবরাহও বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই সুদূর বঙ্গোপসাগর থেকে ফিশিং ট্রলার বোঝাই ইলিশ গিয়ে নামছে কক্সবাজার শহরের ফিশারি ঘাটে। কিন্তু বিধিবাম; সুস্বাদু ইলিশে বাজার ভরে উঠলেও দাম কমেনি মোটেও।
আকাশছোঁয়া দামের কারণে বাজারে দরদাম করেই বাড়ি ফিরছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। অধরাই থেকে যাচ্ছে রুপালি ইলিশ। মনে চাইলেও অনেকেই সুস্বাদু ইলিশের স্বাদ মুখে নিতে পারছেন না।
৫শ’ থেকে ৭শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকারও বেশি। তাই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ বাজারে এসে ইলিশের দর-দাম করেই বাড়ি ফিরছেন। ইলিশের স্বাদ আর মুখে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাশের বাড়ির ইলিশ ভাজার সুবাস নিয়েই আপাতত সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের।
ছৈয়দ আলম নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ভরা মৌসুম চলছে। সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। তাই বছরের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন কাঁচাবাজারে ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু দাম কমেনি। অক্টোবরে থেকে ইলিশ আহরণ আবারো বন্ধ থাকবে। তাই আরো কয়েক মাস বাজারে ইলিশ মাছের প্রাচুর্য থাকবে। কিন্তু বাজারের ইলিশের দামে আগুন লেগেছে। ভরা মৌসুমেই যখম এমন দাম। তখন অন্য সময় দাম কেমন থাকবে তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে। আগেও যেই দাম ছিল, ভরা মৌসুমেও সেই দাম? বরং এখন একটু বড় ইলিশ পাওয়া যাওয়ায় ক্ষেত্র বিশেষ দাম আরও বেশি হাঁকা হচ্ছে। ১ কেজি ওজনের একটি ইলিশ মাছের স্বাদ নিতে হলে কম করে হলেও ১ হাজার ৪শ’ টাকা খরচ করতে হবে। আর সবচেয়ে ছোট (৪.৫০ গ্রাম) ওজনের একটি ইলিশ মাছ কিনতে গেলেও ৫শ’ টাকার নিচে নয়। তাই বাজারে আসলেও সবার পক্ষেই ইলিশ মাছ কেনা সম্ভব হচ্ছে না।
রমজান আলী নামে আরেক ক্রেতা সিন্ডিকেট করে ইলিশের দাম বাড়ানোর অভিযোগ করেন। বলেন, কক্সবাজার থেকে সরাসরি ট্রাকযোগে ইলিশ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় বাজারে চলে যায়। ক্রেতারা একটু কম দামে ইলিশ পাওয়ার জন্য আগে ভোরে ফিশারী ঘাটে থাকা ইলিশের পাইকারি আড়তে যেতেন। কিন্তু এবার পাইকারি আড়তেও ইলিশের দাম বেশি। আর পাইকারি বাজারে যে দাম খুচরা বাজারেও সেই একই দাম। সব মিলিয়ে যেটা বুঝা যাচ্ছে সিন্ডিকেট করে ইলিশের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কক্সবাজারের যে বাজারেই যান না কেন, ওজন ভেদে ইলিশের দাম একই রকম।
এদিকে ফিশারী ঘাটে ও বড় বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ৪ থেকে সাড়ে ৪শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ টাকা কেজি, ৫শ’ গ্রাম থেকে ৬শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭শ’ টাকায়, ৭শ’ গ্রাম থেকে ৮শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকায়, এক কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৪শ’ টাকায়। আর এর ওপরে থাকা বড় সাইজের ইলিশ মাছগুলো এক হাজার ৫শ’ থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে বড় ইলিশ নিতে একদিন আগেই ওর্ডার দিয়ে আসতে হবে।
ইলিশের খুচরা বিক্রেতা আলী হোসেন। বলেন, প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও এবার ফিশারী ঘাটেই এই মাছের দাম বেশি। এর ওপর পরিবহনের জন্য যোগ হয় বাড়তি খরচ। সবমিলিয়ে তাদেরকে আরো একটু বেশি দামে মাছ বিক্রি করতে হয়। না হলে লাভ হয় না।
আর এই কারণে খুচরা ও পাইকারি বাজারে দামের কোনো তারতম্য নেই। দাম প্রায় একই। তবে যারা সরাসরি পাইকারি বাজার থেকে ইলিশ কিনবেন তারা ছোট ও বড় সাইজের মাছ মিলিয়ে নিতে পারেন। এতে বেশি মাছ নিলে ছোট মাছের সঙ্গে কয়েকটা বড় মাছও পান। খুচরা বাজারে সেই সুযোগ নেই। কারণ এখান থেকে মাছ নিয়ে তারা বড় মাছগুলো সাইজ অনুযায়ী বাছাই করে ফেলেন এবং সেগুলো বিভিন্ন দামে বিক্রি করেন। কারণ ওজন হিসেবেই ইলিশের দাম নির্ধারণ হয়।
বড় বাজারের পাইকারি মাছের আড়তদার জহির মিয়া বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষের পর চট্টগ্রামসহ সারা দেশেই ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার থেকে প্রতিদিনই ৩/৪ ট্রাক ইলিশ আসছে। ফিশারী ঘাটে নিলামের পর কয়েক হাত ঘুরে তার পরই আসছে। ফলে ওজন ভেদে কেজি প্রতি মাছ ৫০ থেকে ১০০ টাকা দাম এমনিতেই বেড়ে যাচ্ছে। এখানে কোনো সিন্ডিকেট নেই বলেও দাবি করেন ইলিশের এই পাইকারি ব্যবসায়ী।
কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ বলেন, দুই মাস পাঁচদিনের নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেও কক্সবাজার উপকূলে ইলিশের খুব একটা দেখা পাননি জেলেরা। সোমবার বড় ইলিশ ধরা পড়েছে। জেলায় ছোট-বড় মাছ ধরা ট্রলার প্রায় ছয় হাজার। এসব ট্রলার নিয়ে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার জেলে-শ্রমিক সাগরে গেছেন। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে মৎস্য বিভাগের নিবন্ধিত ৬৩ হাজার ১৯৩ জেলে পরিবার ৫৬ কেজি করে চাল পেলেও অনিবন্ধিত জেলে পরিবারে কিছুই জোটেনি। এখন মাছ মিলছে, সেসব পরিবারের আর্থিক সমস্যা দূর হবে বলে আশা করছি।
কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ম্যানেজার আহসানুল হক বলেন, নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রথমদিন সাড়ে ১৬ টন মাছ এসেছে। আশা ছিল, সোমবার আরও বেশি মাছ আসবে। কিন্তু সেটা হয়নি। সোমবার ইলিশসহ মাছ এসেছে সাড়ে ১৫ টন। এর মধ্যে ইলিশ হলো সাড়ে সাত টন। রোববার আসা সাড়ে ১৬ টনে ১১ টন ৭০০ কেজি ছিল ইলিশ। প্রথমদিন প্রায় ইলিশের ওজন ছিল ৬০০-৭০০ গ্রাম। সোমবার-মঙ্গলবার পাওয়া ইলিশের ওজন ৮০০ থেকে ১৫০০ গ্রামের মধ্যে ছিল।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ