আমাকে ১৫ মিনিট ধরে হকিস্টিক দিয়ে পেটানোর যে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এমন কোনো বক্তব্য তিনি কোনো সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকেও জানাননি বলে জানিয়েছেন গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা।
বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) দুপুরে নিউমার্কেট এলাকায় নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। সেখানে লিখিত বক্তব্যে এ তথ্য জানান গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা।
একটি পত্রিকা বিষয়টি নিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে, পরে যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় বলেও জানান এ অধ্যক্ষ।
সংবাদ সম্মেলনে সেলিম জানান, একটি কথাকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের মধ্যেই হাতাহাতি-ধস্তাধস্তি হয়। এ সময় ওমর ফারুক চৌধুরী দুই পক্ষকে ধাক্কা দিয়ে দুদিকে সরিয়ে দেন। এতে তাদের কেউ আহত হন, কারও চশমা ভেঙে যায়।
তিনি আরো বলেন, বিষয়টিতে সংসদ সদস্য হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তারা পরবর্তীতে একসঙ্গে বসে আলোচনা ও চা পান করেন। এরপর জাতি গড়ার কারিগরের মতো মহান পেশায় থেকে হাতাহাতি-ধস্তাধস্তি করা ঠিক হয়নি ভেবে অনুতাপ প্রকাশও করেন শিক্ষকরা।
লিখিত বক্তব্যে অধ্যক্ষ সেলিম রেজা বলেন, ১৩ জুলাই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় আমাকে ও রাজশাহী-১ আসনের এমপিকে নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও মনগড়া। এমপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একটি কুচক্রী মহল আগামী ১৫ জুলাই তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে এমন অপপ্রচার চালিয়েছে। একটি মহল গোদাগাড়ী-তানোর নির্বাচনী এলাকায় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর সুনাম, উন্নয়ন ও জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মনগড়া কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করেছেন।
তার দাবি, সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়ে একজন ব্যক্তি আমার বাসায় আসেন। এরপর আমাকে অভিযোগ করার জন্য বিভিন্নভাবে উস্কানি দেন ও আমার ছবি তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি ছবি তুলতে দিইনি। আমি কোনো প্রকার অভিযোগ বা মন্তব্য প্রকাশ করিনি। তারপরও আমাকে ও এমপিকে নিয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছেন।
গত ৭ জুলাইয়ের প্রকৃত ঘটনার অন্যরকম ছিল জানিয়ে শিক্ষক সেলিম বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা কয়েকজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ঈদ উপলক্ষে এমপি সাহেবের অফিসে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এ সময় আমাদের অধ্যক্ষ ফোরামের কমিটি গঠন এবং অভ্যন্তরীণ অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে এমপি মহোদয় আমাদেরকে নিবৃত করেন। এছাড়া আর অন্য কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ঘটনার রাতে নিউমার্কেটের চেম্বারে যে সাত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের সামনে সেলিম রেজাকে পেটানো হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়, তারাও বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন- গোদাগাড়ী পাকড়ি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল গাফফার, গোদাগাড়ীর চব্বিশ নগর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আহসান হাবিব, গোদাগাড়ী মহিলা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ শহীদুল করিম শিবলী, মাটিকাটা আদর্শ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল আওয়াল রাজু, প্রেমতলী ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান হিরো, গোদাগাড়ী সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঈনুল ইসলাম ও গোদাগাড়ী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ইমনুল কায়েস।
সেলিমের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন গোদাগাড়ী-তানোর আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। বক্তব্যের শুরুতেই এমন মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করায় দেশ-বিদেশে তার যে সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে, সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন তার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বিচার চান ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কোন মাধ্যমে এসব ক্ষতিপূরণ সম্ভব তা নির্ধারণের ভারও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ছেড়ে দেন তিনি।
ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ তার বিরুদ্ধে এভাবে একের পর এক চক্রান্ত করে চলেছেন। তিনি এমন একটি মিথ্যা খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়েছেন। আর এ ঘটনা ঘটানোর পর তাকে নিয়ে গণমাধ্যমে যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন তা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ। এমনটি তিনি আগেও করেছেন।
এ সংসদ সদস্য আরও বলেন, তিনি (আসাদুজ্জামান আসাদ) বলে বেড়ান, আমি নাকি জীবনেও নৌকায় ভোট দেই না। আমি যদি নৌকায় ভোট না দেই তাহলে তিন তিনবার এমপি হলাম কীভাবে? এই আসাদই আমার বাবাকে রাজাকার বলেছিল। তিনি প্রকাশ্যে বলে বেড়ান- আমি নাকি রাজাকারের ছেলে। অথচ আমার বাবা ও চাচাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৫ নভেম্বর বাবলা বনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অপরাধ কী? জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামানের ছেলে খায়রুজ্জামান লিটন ও তার আম্মা আমাদের গ্রামে ছিলেন এবং আমার বাবা তাদের ভারতের পার করে দিয়েছিলেন। এ কারণে আমার বাবা ও চাচাকে একসাথে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা করা হয়েছিল। এই ইতিহাস রাজশাহীর মানুষ সবাই জানেন। আর এই আসাদ বলে- আমার বাবা রাজাকার আর আমি রাজাকারের সন্তান। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি এর বিচার চাই।
রাজশাহীর এ সংসদ সদস্য আরো বলেন, আসাদের আমার ওপর এত রাগের কারণ হলো- তিনি মনে করেন আমার জন্য তিনি রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে পারেননি। এজন্য তিনি একের পর এক চক্রান্ত করে যাচ্ছেন। তাই এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসাদের এই বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডলো দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি করছি।
এদিকে শিক্ষক পেটানোর ঘটনাটি গণমাধ্যমে খবর আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর বুধবার (১৩ জুলাই) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তা আতাউর রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গত বুধবার অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে মারধরের ঘটনা জানার পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. মশিউর রহমান এ তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। কমিটিকে যত দ্রুত সম্ভব সরেজমিনে ঘটনা বিস্তারিত জেনে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন উপাচার্য। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি উল্লেখ করে অধ্যক্ষ সেলিমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি তদন্ত কমিটির কাছে সত্য তুলে ধরব। আমি পিটুনির শিকার হইনি, তা বলব।
সংসদ সদস্যের মারধরের ব্যাপারে যে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে বলা হয়, অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে ১৫ মিনিট সময় ধরে সবার সামনে পেটানো হয়। সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বেপরোয়া লাথি, কিল-ঘুসি ও হকি স্টিকের আঘাতে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালশিরা জমেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ও আতঙ্কিত ওই শিক্ষক এখনো ভীতসন্ত্রস্ত। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে নগরীর রায়পাড়ার বাসায় পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করছেন।
এমপির হাতে নির্দয় পিটুনির শিকার হলেও অধ্যক্ষ সেলিম রেজা লজ্জা ও আতঙ্কে কোথাও অভিযোগ করেননি। ফারুকের হুংকারে কেউ তাকে বাধা দিতে সাহস পায়নি। ঘটনার পর অধ্যক্ষদের একজন সেলিমকে এমপির কব্জা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেম্বার থেকে বের করে আনেন। আহত অবস্থায় ওই শিক্ষককে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সাঈদ আহমেদের চেম্বারে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর কয়েকজন স্বজন ও সহকর্মীর সহায়তায় তিনি বাসায় ফেরেন। ঘটনার পর অধ্যক্ষ সেলিম রেজা ক্ষোভে লজ্জায় বাসা থেকে আর বের হননি।
তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি সম্পর্কে রাজশাহী ১ আসনের সংসদ সদস্যর কাছে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে তার চেম্বারে অনেকেই গিয়েছিলেন। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করলে তাদেরকে থামিয়ে দেন ওমর ফারুক।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ