খুলনায় এবার কিছুটা বেড়েছে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম। বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন ১শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে, বাড়তি মূল্যের সুবিধা পাননি সবাই। যে যেভাবে পেরেছেন দর কষাকষি করেই কেনা-বেচা করেছেন চামড়া, ছিল না কোন নিয়ন্ত্রণ। তবে কোরবানি পশুর চামড়া ভারতে পাচার রোধে খুলনাঞ্চলের বেনাপোল-শার্শা সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
এদিকে, গত বছরের তুলনায় চামড়ার দাম কিছুটা বাড়ায় বিভিন্ন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান বাড়তি দাম না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। কোরবানির চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থে বছরের খাবারের বড় একটি অংশের যোগান হয় মাদ্রাসার দরিদ্র ইয়াতিম (লিল্লাহ বোর্ডিং)’র শিক্ষার্থীদের।
অপরদিকে, খুলনায় এবার চামড়ার নির্দিষ্ট কোন বাজার (স্থান) না থাকায় নগরীর শেখপাড়া এলাকায় অস্থায়ীভাবে সড়কে দাঁড়িয়েই কোরবানির পশুর চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এ বছর ছিল না মৌসুমী ব্যবসায়ীদের তেমন কোন দাপট। ফলে চামড়া সংরক্ষণে ব্যবসায়ীরা বেশ বিপাকে পড়েছেন। অনেকেই নিজ বাড়ি অথবা ঘর ভাড়া নিয়ে লবণজাত করছেন চামড়া।
খুলনার লবণচরা হাজী আব্দুল মালেক ছালেহিয়া দারুস সুন্নাত দাখিল মাদ্রাসা ও ইয়াতিমখানার ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মো. শাফায়াতুল ইসলাম জানান, এ বছর তাদের প্রতিষ্ঠানে মোট ১০১টি গরুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়। যার মধ্যে ছোট সাইজের প্রতিটি ৩শ’ টাকা এবং বড় সাইজের চামড়া প্রতিটি সাড়ে ৫শ’ টাকা করে বিক্রি করেছেন।
তিনি বলেন, গত বছর মাত্র ২২৫ টাকা করে প্রতিটি চামড়া বিক্রি করতে হয়েছিল। আর ছোট গরু ও ছাগলের চামড়া মাটির নিচে চাপা দিতে হয়েছিল। সে তুলনায় এবার প্রায় দ্বিগুণ দামে চামড়া বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে।
অপরদিকে খুলনার মদিনানগর মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মুফতী কামাল হোসেন বলেন, সংগৃহিত চামড়ার মধ্যে ছোট আকারের প্রতিটি দেড়শ’ টাকা এবং বড় সাইজের চামড়া ৪শ’ টাকা পিস বিক্রি করেছেন তারা। তবে, দাম আরও বাড়তি থাকলেও পাইকাররা কৌশলে কম দিয়েছেন।
লবণচরা দক্ষিণ মোহাম্মদনগর রূপসী রূপসা এলাকার আমির হোসেন মোল্লা কওমী মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের মোহতামিম মুফতি আল আমিন জানান, আগে এমন একটা সময় ছিল যখন চামড়ার দাম ছিল আকাশচুম্বি। তখন পশু জবাই করতে এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং এর ছাত্র ছুটে বেড়াতো। কিন্তু বিগত কয়েকবছর পশুর চামড়ার দাম নেই বললেই চলে। গত দু’ বছর বাধ্য হয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয় চামড়া। তবে এাবার কিছুটা বেড়েছে চামড়ার দাম।
নগরীর খালিশপুর এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী মো. আব্দুল খালিক বলেন, এবার তিনি সর্বনিম্ন সাড়ে ৩শ’ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চামড়া কিনেছেন। এর মধ্যে ছোট চামড়া সাড়ে ৩শ’, মাঝারি ৪শ’ থেকে ৮শ’ এবং বড় সাইজের প্রতিটি চামড়া কিনেছেন ৯শ’ থেকে ১ হাজার টাকায়। তবে তিনি কোন সাইজ কত টাকায় বিক্রি করতে পেরেছেন- সেটি বলতে রাজি হননি। দৌলতপুরের মিনাক্কি এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী মো. সেলিম শেখ বলেন, তিনিও এবার সাইজ অনুযায়ি ৩শ’, ৫শ’, ৭শ’, ৮শ’ এবং ১ হাজার টাকা মূল্যে প্রতিটি চামড়া ক্রয় করেছেন।
চামড়া ব্যবসায়ী মো: বাবর আলী জানান, নেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নির্ধারিত স্থান। রাস্তায় দাড়িয়ে চামড়া কিনতে হয়। স্থান না থাকায় চামড়া কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করতে করতে ৫০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। ব্যবসায়ী মো: জাফর বলেন, একেতো নেই স্থান, তার ওপর পুঁজি সংকট। ট্যানারী মালিকদের কাছে খুলনার ব্যবসায়ীদের দেড় কোটির বেশী টাকা পাওনা রয়েছে।
চামড়া ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল বলেন, ট্যানারী মালিকদের নিকট টাকা বকেয়া রয়েছে। প্রতিদিনই আশ্বাস দেয় টাকা দেবে। কিন্তু টাকা দেয় না। এই টাকা না পাওয়ায় পর্যাপ্ত চামড়া কেনা সম্ভব হয়নি।
খুলনার চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম ঢালী জানান, এ বছর ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা মূল্যের গরুর চামড়া ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা, ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা মূল্যের গরুর চামড়া ৫শ’ টাকা এবং লাখ বা তার ওপরের চামড়া সর্বোচ্চ ৬শ’ টাকা করে প্রতি পিস তারা কিনেছেন। তারওপর প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণ করতে ২/৩শ’ টাকা খরচ রয়েছে। তিনি বলেন, কোরবানির ঈদকে টার্গেট করে প্রতি বছরের মত এবারও বস্তাপ্রতি ২শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত লবণের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে জরুরি প্রয়োজনে চামড়া ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত অর্থেই লবণ কিনতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া চামড়া ক্রয়ের জন্য তারা নগরীর শেখপাড়ায় (সাবেক চামড়া পট্টি) অস্থায়ীভাবে এক সপ্তাহের জন্য সড়কে দাড়িয়ে চামড়া কিনছেন। তবে অনেকেই নিজ বাড়ি অথবা ঘর ভাড়া নিয়ে সংরক্ষণ করছেন চামড়া।
চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির এই নেতা আরো বলেন, খুলনার চামড়া ব্যবসায়ীদের বিগত বছরগুলোর কয়েক কোটি টাকা ঢাকার ট্যানারী ও আড়তে বকেয়া রয়েছে। ফলে এ ব্যবসায় নতুন করে আসছে না কেউ বরং কমছে। এবার সব মিলিয়ে ১২/১৫জন ব্যবসায়ী এবং কিছু ফঁড়িয়া চামড়া কিনেছেন বলেও জানান তিনি।
সীমান্তে সতর্কতা :
কোরবানি পশুর চামড়া ভারতে পাচার রোধে খুলনাঞ্চলের বেনাপোল-শার্শা সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। নজরদারিতে আনা হয়েছে বন্দর এলাকাসহ স্থল ও রেলপথ। সীমান্ত এলাকায় বিজিবির টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়েছে বিজিবি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেনাপোল ও শার্শার পুটখালী, গোগা, কায়বা, অগ্রভুলোট, রুদ্রপুর, দৌলতপুর, গাতিপাড়া, ঘিবা, সাদিপুর, বড় আঁচড়া, কাশিপুর, রঘুনাথপুর শিকারপুর, শালকোনা এবং শাহজাতপুর সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে।
খুলনা ২১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মুনজুর-ই-এলাহী বলেন, ভারতে কোরবানির পশুর চামড়া পাচার রোধে বেনাপোল ও শার্শার বিভিন্ন সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে বিজিবি। যশোরের যে সমস্ত সীমান্ত দিয়ে চামড়া পাচারের সম্ভাবনা থাকে, সে সমস্ত এলাকা বেশি নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যাতে কেউ অবৈধভাবে ভারতে চামড়া পাচার করতে না পারে এজন্য ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তগুলো চিহ্নিত করে টহল ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ আদেশ বলবত থাকবে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ