ফ্রিজিয়ান জাতের ৩৮ মণ ওজনের সম্রাট এ ঈদেও বিক্রি হয়নি। এনিয়ে দুবার বিক্রির চেষ্টা করেও কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় মালিক রফিকুল ইসলামের (৩৫) খামারেই পরে রইল ফ্রিজিয়ান জাতের ৩৮ মণ ওজনের এ গরুটি। রফিকুল ইসলামের এই ফার্মটি শহরতলীর বিল মামুদপুর এলাকায় অবস্থিত।
এ গরুটি নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছিল '৩৮ মণ ওজনের এই গরু কেনার মতো ক্রেতা মিলছে না ফরিদপুরে। এজন্য সম্রাটকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
এ খবর গত ৩০ জুন পর্যন্ত কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। মূলত গরুটিকে ঢাকায় নেওয়া তো দূরে থাক ফরিদপুরের কোনো হাটেই তোলা হয়নি। মালিক রফিকুল ইসলাম গরুটি নিজের খামার থেকে বিক্রির জন্যই ক্রেতা খুঁজছিলেন। ২০২১ সালেও এটি ফরিদপুরের বড় গরু ছিল। ওই বছরও গরুটি কোনো হাটে তোলা হয়নি। ফরিদপুরের স্থানীয় কোনো বাজারেও গরুটি বিক্রির জন্য প্রদর্শন করা হয়নি।
ঢাকার হাট 'কাঁপাতে' পদ্মাসেতু পাড়ি দেবে সম্রাট- সংক্রান্ত যেসব খবর প্রকাশ করে কয়েকটি গণমাধ্যম, তা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই। বাস্তবতা হচ্ছে পদ্মাসেতু পাড়ি দেওয়ার সৌভাগ্য সম্রাটের হয়নি। সম্রাটকে নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রকাশিত খবরের এই অংশটুকু পাঠকের কাছে মুখরোচক গল্প হয়েই থেকে গেল।
এদিকে গরুটির মালিক রফিকুল ইসলাম কাঙ্খিত দাম না পেয়ে হতাশ।
ফরিদপুর শহর থেকে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটার দূরে শহরতলীর বিল মাহমুদপুর গ্রামে মাইশা ডেইরি ফার্ম নামে একটি গরুর খামার আছে। এ খামারেই সম্রাটের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ৩৮ মণ ওজনের সম্রাট দৈর্ঘ্য এগারো ফুট, প্রস্থে আট ফুট ও উচ্চতা ছয় ফুট।গরুটির দাম দশ লাখ টাকা চাওয়া হলেও সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি দাম উঠেনি।
রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালে এ ফার্মটি স্থাপন করেন তিনি। রফিকুল ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিষয়ে বিএসসি পাস করেছেন। এরপর তিন বছর চাকরি করেছেন একটি বেসরকারি ফার্মে। চাকরিরত অবস্থায় প্রবাসী বড় ভাই মামুনুর রহমানের অনুপ্রেরণায় এ ফার্মটি দেন। চারটি গরু নিয়ে যাত্রা করে ফার্মটি। প্রথমে দেখাশোনা করতেন ছোট ভাই সাইদুর রহমান। ২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি খামারি হয়ে ওঠেন রফিকুল।
রফিকুল জানান, ফ্রিজিয়ান জাতের এই গরুটির বয়স ৪৩ মাস। সম্রাটের জন্ম এই ফার্মেই। তার মা বেঁচে নেই। জন্মের সময় সম্রাটের ওজন ছিল প্রায় ৬০ কেজি। সম্রাটকে দেখাশোনা করতেন সালাম শেখ (২২) নামে এক তরুণ। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। জন্মের সময় সম্রাট ছিল নাদুস-নুদুস। এটা যে বড়সড় একটা গরু হবে তার ছাপ জন্মের সময় ছিল সুস্পষ্ট।
সালাম শেখ রফিকুলকে বলেছিল, ওর নাম রাখা হোক সম্রাট। কেননা ওর আচার-আচরণ সম্রাটের মতোই। কাউকেই পরোয়া করে না। এটি বড় না হওয়া পর্যন্ত বিক্রি করবেন না।
সালামের কথা রেখেছেন রফিকুল। সম্রাটের জন্মের ৩২ মাস পর গত কোরবানির হাটে তাকে বিক্রির জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু করোনা মহামারির জন্য আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় সেবার আর গরুটি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তাই ৪৩ মাস পর এ বছর কোরবানির ঈদে গরুটি তিনি বিক্রি করতে চেষ্টা করেন। দাম গত বছর চেয়েছিলেন দশ লাখ টাকা। এবারও তাই-ই রেখেছিলেন। গত বছর গরুটির ওজন ছিল ৩৩ মণ, এক বছরে ওজন বেড়েছে আরও পাঁচ মণ।
রফিকুল বলেন, গত বছর করোনার কারণে সম্রাটকে কোনো হাটে উঠাতে পারিনি। বাড়িতে এসে ব্যাপারীরা দেখে বিভিন্ন দাম বলেছিল। গতবছর সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা দাম উঠেছিল। এবার কয়েকজন ব্যাপারী আসলেও রফিকুলের চাহিদা অনুযায়ী দাম তারা বলেনি।
তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে ওজনে পাঁচ মণসহ সবদিক দিয়েই গরুটি আরও স্বাস্থ্যবান ও পরিপক্ক হলেও দামে খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি। গত বছর গরুটির দাম পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠে। এক বছর পর এবারও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ছয় লাখ টাকার ওপরে দাম বলেনি।
তবে গরুটি এবার বিক্রি না হওয়ার পেছনে একটি ঘটনাকে সামনে আনছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি দাবি করছেন, গত ৩০ জুন তার মুঠোফোনে একটি কল আসে। দিনু (৪০) নামের ফরিদপুর শহরতলীর লক্ষ্মীপুর মহল্লার বাসিন্দা পরিচয়ে গরুটি কেনার আগ্রহ দেখান। সেই মোতাবেক সাড়ে সাত লাখ টাকা দামে ক্রেতা গরুটি কেনার জন্য গত সোমবার (৪ জুলাই) বিশ হাজার টাকা বায়না দেন। এরপর আর ওই ক্রেতার খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওই ক্রেতার মুঠোফোন নম্বরে কল দিলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এজন্য সম্রাটকে বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। বায়নার ওই বিশ হাজার টাকা এখনো রয়ে গেছে রফিকুলের কাছেই।
রফিকুলের সঙ্গে আলাপ হলে তিনি জানান, তার বড় একটি গরুর খামার চালাতে হয়। আর ঢাকা একটি গরুকে নিতে হলে ট্রাক ভাড়া করাসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক মানুষ এবং অমানুষিক কষ্টের ব্যাপার রয়েছে। এজন্য সম্রাটকে বাড়ি থেকেই বিক্রি করতে চেয়েছিলেন তিনি। পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ঢাকায় নেওয়া বা ফরিদপুরের কোনো স্থানীয় হাটে তোলায়ও তার অনাগ্রহ ছিল।
এই গরুকে আগামী কোরবানি ঈদে বিক্রির জন্য রাখবেন কিনা? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,গরুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রতিদিন অন্তত পাঁচশত টাকার খাদ্য তাকে দিতে হয়। এজন্য তিনি আগামী কোরবানির ঈদের জন্য গরুটিকে রাখবেন না। এর আগেই সুবিধাজনক সময়ে কসাইদের মাধ্যমে কেজি দরে বিক্রির উদ্যোগ নেবেন।
গরুকে বড় করে বিপদে পড়েছি- মন্তব্য করে রফিকুল বলেন, সম্রাটকে নিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হলো তা থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি খামারে গরু আর বেশি বড় করব না। পাঁচ ছয় মণ ওজন হলেই বিক্রি করে দেব।
অন্য খামারিদের প্রতি আমার উপদেশ, আপনারা যারা খামারি আছেন, বড় গরু তাদের পালন করা উচিত নয়। একটি গরু সর্বোচ্চ পাঁচ-ছয় মণ ওজনের হলেই সেটিকে বিক্রি করে দিলে ভালো হবে। তাতে গরুর লালন পালন বাবদ খরচও কম পড়বে লাভও বেশি হবে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ