ঢাকা, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পি কের ঋণের ফাঁদে ভালুকার কুুমির খামার

প্রকাশনার সময়: ০৪ জুলাই ২০২২, ১৪:৪৫

প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে) ঋণের ফাঁদে পড়েছে দেশের প্রথম কুমিরের খামার ‘রেপটাইলস ফার্ম’। ফলে ভালুকায় অবস্থিত ওই খামারের দেখভাল করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে বর্তমান কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ৩ হাজার কুমিরের খাবার জোগান দেয়াই এখন কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে পারিশ্রমিক না পাওয়ায় অভাব-অনটনে দিন পার করছেন কর্মরত শ্রমিকরা। যদিও বর্তমান এই খামারের ৪৯ শতাংশ মালিক এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা চাইলেই সমঝোতার ভিত্তিতে প্রকল্পটি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারে বলে দাবি করেছেন কর্মরত কর্মচারীরা।

জানা গেছে, মুশতাকের স্বপ্নের কুমিরের খামারটি ২০১৩ সালে দখলে নেন পি কে হালদার। এরপর প্রতিষ্ঠানটির নামে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নেন পি কে হাওলাদার। যার কোনোটিই শোধ হয়নি। দেশের প্রথম এই কুমির খামারের স্বপ্নদ্রষ্টা ও অন্যতম অংশীদার ছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক অবস্থায় কারাগারে মারা যাওয়া মুশতাক আহমেদ। যদিও মৃত্যুর আগে তার কাছ থেকে জোর করে অংশীদার লিখে নেয়ার অভিযোগ করেছিলেন মুশতাক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খামারটি প্রতিষ্ঠার শুরুতে ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের। আর ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল মুশতাক আহমেদের। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ প্রকল্পের ঋণ নেয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেয়ার ছিল তখন ৪৯ শতাংশ। কুমিরের খাবার, বাচ্চা প্রজনন ও পরিচর্যার কাজে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ায় কার্যত ভালুকার খামারটি সংকটে পড়ে। ২০১২ সালে খামারের শেয়ার ছাড়তে বাধ্য হন মূল উদ্যোক্তা মুশতাক আহমেদ। মালিকানায় চলে আসেন প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। প্রথম অবস্থায় কুমির খামারটি পি কে হালদারের হাতে তুলে দেন মুশতাক আহমেদের ব্যবসায়িক অংশীদার মেজবাহুল হক। তিনি বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক। ২০১৩ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থাকার সময় পি কে হালদার কুমির খামারটির নিয়ন্ত্রণ নেন। পি কে হালদার খামারটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েই রেপটাইলস ফার্মের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ তুলে নেন, যার কোনোটিই শোধ হয়নি এখনো।

সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকার সময় পি কে হালদার মুশতাকের খামারটি কৌশলে দখলে নেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন মুশতাকের ব্যবসায়িক অংশীদার মেজবাহুল হক। মেজবাহ সে সময় একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন এবং খামারের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। মুশতাক ছিলেন এমডি। খামারটি পি কে হালদারের হাতে তুলে দিয়েই মেজবাহুল হক দেশে ছেড়ে চলে যান। এর কিছুদিন পরে পি কে হালদারের চাপে পড়ে মুশতাক আহমেদ তার নামে থাকা খামারটির শেয়ার হস্তান্তরের দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। পি কে হালদারের ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডের বাসায় স্বাক্ষর করেন মুশতাক। খামার হাতছাড়া হওয়ারও সাত বছর পর দুঃখ ভারাক্রান্ত হূদয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন মুশতাক আহমেদ।

২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নিজের ফেসবুকে খামারটির মালিকানা বদল নিয়ে মুশতাক লিখেছিলেন, ‘কুমিরের খামার এখন হায় হায় কোম্পানি। ২০১০ সালের ৩রা জুন ছিল বিশেষ দিন। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে কুমির রফতানি হবে। এর দুই মাস পর চেয়ারম্যান মেজবাহুল হক ঘোষণা দিলেন, কোম্পানি বিক্রি করে দেবেন, আমাকে একটা সাদা কাগজ দিয়ে বললেন সেখানে সাইন করতে। আমি বলে দিলাম সেটা সম্ভব না। শুরু হলো কোর্ট-কাচারি। এরপর প্রশান্ত কুমার হালদার এলেন সামনে। তিনি আমাকে যা বললেন, তাতে বুঝলাম, প্রশান্তের কথায় রাজি না হলে, আমার আম ও ছালা দুইটাই যাবে। একপর্যায়ে আমি আমার শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হলাম।’

মুশতাক আহমেদ আরো লিখেছেন, ‘চেয়ারম্যান (মেজবাহুল হক) তখন আবার এবি ব্যাংকের ডিরেক্টর ছিলেন, তাই ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই প্রশান্তকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ণোদ্যমে ফার্মের সমস্ত অবকাঠামো নির্মাণ শেষ করে ফেলেন। কোম্পানির সমস্ত কাগজপত্র নতুন করে তৈরি করা হয়। সমস্যা দেখা দেয়, যখন জন্মের সময় নয় ইঞ্চি কুমির ছানা দশ বছর পরে আট নয় ফুট লম্বা হয়ে যায়। ৩২০০ কুমির কিলবিল করতে থাকে। পি কে কুমিরের ফার্মের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে জমি কিনে, শেয়ার কিনে, কিন্তু কুমির বেচতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের মতো পালায় দেশ ছেড়ে। ভালুকার ফার্মে তালা দিয়ে কর্মকর্তারা পলাতক। কর্মচারীরা প্রায় কয়েক মাস যাবৎ বেতন না পেয়ে অসহায় দিনযাপন করছেন। সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস একটা কুমিরের খামার এখন হায় হায় কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।’

স্থানীয়রা জানান, ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে হাতিবেড় গ্রামে ১৩ একর জমিতে দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার করেন মুশতাক। এরআগে বাংলাদেশে কুমির চাষের ধারণা কারো ছিল না। তার খামারটির নাম-রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। ২০১৯ সালে ২৫১টি কুমিরের চামড়া জাপানে রফতানি করা হয়েছে। প্রতিটি চামড়ার মূল্য ধরা হয়েছে ৫০০ ডলার করে। ২০০৪ সালে মাত্র ৭৫টি কুমির নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই খামারে বর্তমানে ৩ হাজার ১০০ কুমির রয়েছে। মূলত মুশতাক আহমেদ ও মেজবাউল হক ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। চাকরি ও লেখাপড়ার সুবাদে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তখনই উদ্যোক্তা হয়ে কুমির চাষ শুরু করেন। তারাই দেশে প্রথম কুমির চাষ শুরু করেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০০৪ সালের ৫ মে এ খামার প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয়। খামারের জন্য ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া থেকে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে আনা হয় ৭৫টি কুমির। এখানে কুমির প্রজনন ও লালন-পালন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। শুরুতে খামারটির আয়তন ১৪ একর হলেও এখন তা গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ২৫ একরে।

কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড় ও দাঁত চড়া মূল্যে বিক্রি হয় আন্তর্জাতিক বাজারে। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ২০১০ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম ৬৯টি হিমায়িত কুমির রফতানি করা হয়। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে জাপানে মোট ১ হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া রফতানি করা হতো। গত চার বছরে মোট ১২৫৬টি কুমিরের চামড়া রফতানি হয়। ২০২১-২২ সালে এখান থেকে প্রতি বছর এক হাজার কুমিরের চামড়া রফতানি করা হয়। তাছাড়া কুমিরের দাঁত, হাড়সহ অন্যান্য অংশ বিদেশে রফতানি করা যায়। কোম্পানির ঋণসংক্রান্ত আইনি জটিলতায় রফতানি এখন বন্ধ। এখন শুধু খরচ হচ্ছে, আয় নেই। এ জন্য কুমিরগুলোকে খাবার দেয়া হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে কম। প্রজনন ক্ষমতা ও শক্তি হারিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্বল হচ্ছে কুমিরগুলো।

খামারের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবু সাইম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আগে এসব কুমিরের খাবারে মাসে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হতো। এখন সেটা লাখেরও নিচে নেমে গেছে। কারণ ২০২০ সালের অক্টোবরে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট জব্দ হলে খাবারের স্বাভাবিক জোগান বন্ধ হয়ে যায়।’

আরিফুল জানান, আইনি জটিলতা ও বিকল্প আয় না থাকায় আশপাশের বিভিন্ন খামার থেকে মরা মুরগি সংগ্রহ করে কুমিরগুলোকে দেয়া হচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ