কুমিল্লা সিটির নানা ঝল্পনা-কল্পনার ভোট শেষ হয়েছে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আরফানুল হক রিফাত পড়েছেন বিজয়ের মুকুট। হ্যাটট্রিকের আশায় বিভোর সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু অল্প ব্যবধানে প্রথমবারের মত পরাজিত হয়েছেন। এরই মধ্য দিয়ে কুমিল্লা সিটি প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবার এবং পৌরসভা-সিটি মিলিয়ে ৩১ বছর কুমিল্লা নগরপিতা হলেন কোনো আওয়ামী লীগের নেতা।
বুধবার (১৫ জুন) রাতে ফলাফল ঘোষণা হলেও বৃহস্পতিবারও (১৬ জুন) কুমিল্লা জুড়ে ছিলো ভোটের রেশ। নগরীর পাড়ামহল্লা, অলি-গলি সর্বত্রই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো রিফাতের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের জয়, শিল্পকলার অডিটোরিয়ামের হট্টগোল, সাক্কুর পরাজয়ের কারণ।
তবে সব ছাপিয়ে উচ্ছাস ছিলো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভা মিলে ৩১ বছর এইবারই আওয়ামী লীগের কোনো নেতা কুমিল্লার নগর ভবনে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার সকাল হতেই নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছায় দিন শুরু করেন আরফানুল হক রিফাত। রিফাতের মনোহরপুরের বাসায় গণমাধ্যমকর্মী, দলীয় নেতাকর্মীদের আনাগোনা লেগেই ছিলো। এদিন বিকেলে নগর উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রিফাত। এরপর মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে কুমিল্লা সদর আসনের সাংসদ আকম বাহাউদ্দিন বাহারকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালে শ্রদ্ধার্ঘ জানান তিনি।
এদিন গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তারা নৌকার প্রতি আস্থা রেখেছে। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সিটি করপোরেশনের দুর্নীতি বন্ধ করব। দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করব। এই সিটি করপোরেশন হবে গণমানুষের কার্যালয়। দলীয় কার্যালয় বানাব না।
এসময় তিনি আরো বলেন, আর নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য আমি কিছু নগরবিদদের সাহায্য নিবো। প্রয়োজনে দেশের বাহিরে যারা বাঙ্গালি নগরবিদ আছেন ওনাদের সাহায্য নিবো। সবার সাথে বসবো, এক্ষেত্রে যদি প্রয়োজন হয় আমি প্রাক্তন মেয়রের সহযোগীতাও নিবো। ওনাদেরকে নিয়ে বসে আমি নতুন নগর করার জন্য, নতুনভাবে সব কিছু করার জন্য চেষ্টা করবো। এই জলবদ্ধতা এবং যানযট থেকে কুমিল্লার মানুষকে যাতে আমি মুক্তি দিতে পারি সেই চেষ্টাই করবো।
এর আগে, বুধবার দিনব্যাপী ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমী হতে ফলাফল ঘোষণা শুরু করেন রির্টানিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী। তিনি যখন একে একে কেন্দ্রগুলোর ফলাফল ঘোষণা করতে থাকেন তখন থেকেই দুই প্রার্থী আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত ও গত দুইবারের মেয়র বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত মিলতে থাকে। দুই জনের মধ্যে ভোটের ব্যবধান শুরু থেকেই ছিল কম। একবার সাক্কু এগিয়ে যান, তো আরও কয়েকটি কেন্দ্রের ফল আসলে দেখা যায়, এগিয়ে গেছেন রিফাত। এভাবেই চলতে থাকে ফলাফল ঘোষণা। এর মধ্যে ১০০তম কেন্দ্রের ফল যখন ঘোষণা করা হয়, তখন সাক্কু ৬২৯ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি হেরে যান।
১০০তম কেন্দ্রের ফল ঘোষণার সময় ফল ঘোষণার কেন্দ্র শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে শুরু হয় হাঙ্গামা। শিল্পকলা একাডেমিতে দলে দলে আসতে থাকে আওয়ামী লীগ ও সাক্কুর সমর্থকরা। দুই পক্ষ সেখানে পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিতে থাকে। সে সময় কিছু সময় ফল ঘোষণা বন্ধ রাখেন রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন, তখন বাইরে নৌকার সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন আর সাক্কুর সমর্থকরা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
এই সময় ফলাফল প্রত্যাখান করে সাক্কু বলেন, ১০০তম কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে একটু সময় চান। এই সময়টা তিনি কেন নিলেন? তিনি কেন ফলাফল বন্ধ রাখলেন। এই সময়টায় কেন আমাকে মারতে আসল? আমি রেজাল্ট প্রত্যাখ্যান করলাম।
বৃহস্পতিবার সারাদিনই মনিরুল হক সাক্কু নগরীর নানুয়ার দিঘির পাড়ের নিজ বাসভবনে ছিলেন। তার নির্বাচন পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানতে একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করা হলেও মুঠোফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে মনিরুল হক সাক্কুর ব্যক্তিগত সহকারী কবির হোসেন মজুমদার বলেন, সাক্কু ভাই আইন বিশেষজ্ঞ এবং তার শুভাকাক্সক্ষীদের সাথে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে আলোচনা করছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন কুসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী। এসময় চার কেন্দ্রের ফল ঘোষণার বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, যে চার কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করতে দেরি হয়েছিল, ওই কেন্দ্রগুলোর প্রিজাইডিং অফিসাররা ফলাফল নিয়ে আসতে দেরি করেছেন। ফলাফল ঘোষণার পর তুমুল বৃষ্টি হয়। যে চার কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা দেরি হয়েছে ওই কেন্দ্রগুলো শহর থেকে দূরে হওয়ায় বৃষ্টির প্রতিবন্ধকতায় প্রিজাইডিং অফিসাররা আসতে দেরি করেছেন।
তিনি আরো বলেন, কোনো প্রার্থীর যদি ভোটের ফল নিয়ে সন্দেহ থাকে, আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।
এর আগে বুধবার সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে সাধারণ ভোটাররা দিনভর পছন্দের প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। কুমিল্লা সিটিতে এবার মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এদের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪ জন। যা মোট ভোটারের শতকরা ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ভোট বাতিল হযেছে ৩১৯টি। মোট বৈধ ভোটের সংখ্যা ১ রাখ ৩৪ হাজার ৭৪৫টি।
কায়সারেই পুড়েছে সাক্কুর কপাল:
গত দুটি নির্বাচনে জয় পাওয়া মনিরুল হক সাক্কু এবার পরাজিত হয়েছেন, আগের চেয়ে পেয়েছেন কম ভোট। এর প্রধান কারণ ভোট ভাগাভাগি। বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করলেও সেখানে পরোক্ষাভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির লড়াই হয়েছে। বিএনপির প্রধান অংশ ছিল সাক্কুর পাশে, কিন্তু আরেক অংশ ছিল স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে পদত্যাগ করে ভোটে দাঁড়ানো নিজামউদ্দিন কায়সারের পেছনে। কায়সার ভোটে দাঁড়ানোর পরই সাক্কুর সাজানো বাগানে নৌকা এবার হানা দেয় কি না, তা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। হয়েছেও তাই। কায়সারের ঘোড়া মার্কায় ভোট পড়েছে মোট ২৯ হাজার ৯৯টি, যেটি দৃশ্যত সাক্কুর পরাজয়ের প্রধান কারণ হয়েছে। বুধবারের ভোটে নৌকা নিয়ে আরফানুল হক রিফাত ভোট পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০টি। মনিরুল হক সাক্কুর টেবিল ঘড়ি মার্কায় ভোট পড়েছে ৪৯ হাজার ৯৬৭টি। তবে যদি কায়সারের ভোট তার বাক্সে পড়ত, তাহলে ভোট পড়তে পারত ৭৯ হাজার ৬৬টি। কিন্তু বিএনপির এই দুই নেতার ভোট ভাগাভাগির সুফল পেয়েছেন নৌকার রিফাত। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে ভোটের মাঠে কায়সার না থাকলে সাক্কু বিএনপির আরো কিছু ভোট পেতেন, তাতে হয়ত ভোটের ফল অন্যরকম হলেও হতে পারতো।
কাউন্সিলর পদে জয়ী যারা:
কুমিল্লা সিটির ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে ২টি ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সাধারণ আসনের বিজয়ীরা হলেন, ১ নম্বর ওয়ার্ডে কাজী গোলাম কিবরিয়া, ২ নম্বর ওয়ার্ডে গোলাম সারোয়ার, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সরকার মাহমুদ জাবেদ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে মো. নাসির উদ্দিন নাজিম, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সৈয়দ রায়হান, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে মো. আমিনুল ইকরাম, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আব্দুর রহমান, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মো. একরাম হোসেন বাবু, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে জমির উদ্দিন খান জম্পি, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মঞ্জুর কাদের মনি, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে হাবিবুর আল আমিন সাদী, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কাজী জিয়াউল হক, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে রাজিউর রহমান, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আবুল কালাম আজাদ হাসেম, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে সাইফুল বিন জলিল, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীর হোসেন বাবুল, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে হানিফ মাহমুদ, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে শওকত মাহমুদ, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে মো. রেজাউল করিম, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে মো. আনোয়ার হোসেন, ২১ নম্বর ওয়ার্ডে কাজী মাহবুবুর রহমান, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে মো. আজাদ হোসেন, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে মো. আনিসুজ্জামান, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে মো. মহিবুর রহমান, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে মো. এমদাদ উল্লাহ, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে মো. আব্দুস সাত্তার ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে মো. আবুল হাসান।
সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিতরা হলেন:
১ নম্বর সংরক্ষিত আসনে কাউছারা বেগম সুমি, ২ নম্বর আসনে নাদিয়া নাসরিন, ৩ নম্বর আসনে উম্মে কুলসুম, ৪ নম্বর আসনে রুমা আক্তার, ৫ নম্বর আসনে নূর জাহান আলম পুতুল, ৬ নম্বর আসনে নেহার বেগম, ৭ নম্বর আসনে তাহমিনা আক্তার, ৮ নম্বর আসনে ফারহানা পারভিন এবং সংরক্ষিত আসন ৯ এ নির্বাচিত হয়েছেন শাহিন আক্তার।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ