কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শেষ হচ্ছে সোমবার মধ্যরাতে। শেষ সময়ে এসে প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। শেষবারের মত ভোট চাইছেন ভোটারদের কাছে, দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি, বলছেন জয়ী হলে নিরসন করা হবে নাগরিক দূর্ভোগ। এদিকে নির্বাচনের বাকী মাত্র একদিন, এই সময় এসে নগরীজুড়ে একটাই আলোচনা কে হচ্ছেন কুমিল্লার নগর ভবনের কর্তা। নগরীর অলিগলি, পাড়া- মহল্লা সর্বত্রই ভোটের সমীকরণ মেলানোর প্রচেষ্টা।
এবারের কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচজন থাকলেও লড়াই হবে তিন হেভিওয়েটকে কেন্দ্র করে। ভোটের মাঠের সব সমীকরণ আবর্তিত হচ্ছে এই তিনজনকে কেন্দ্র করেই। দুইবারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু কি এবার হ্যাট্রিক করবেন নাকি প্রথমবারের মত আওয়ামী লীগের নৌকাকে নগরভবনে নিতে পারবেন আরফানুল হক রিফাত। সাক্কু-রিফাতের বাহিরে ভোটের মাঠে লড়ছেন নির্বাচনে অংশ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত নিজামউদ্দিন কায়সার। কুমিল্লার রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন এ নির্বাচনে কায়সারেরও চমক দেখানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার পর দুই মেয়াদের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। দলীয় প্রতীক বিহীন প্রথম নির্বাচনে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাক্কু হারান কুমিল্লা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আফজাল খানকে। এরপরের নির্বাচনে আফজাল খান কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে পরাজিত করেন ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা মনিরুল হক সাক্কু। যদিও গুঞ্জন রয়েছে কুমিল্লা আওয়ামী লীগে চলে আসা দীর্ঘদিনের আফজাল-বাহার দ্বন্দ্বের ফায়দা লুটতে পেরেছিলেন সাক্কু। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবার আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত আরফানুল হক রিফাত। পাশাপাশি সাক্কুকে রুখতে এবার ভোটের মাঠে আছে আরেক বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। কুমিল্লার বিএনপি'র রাজনীতিতে মনিরুল হক সাক্কু এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপি'র আহবায়ক হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিনের দীর্ঘকালের দ্বন্দ্ব। এবার নির্বাচনে লড়াই করা নিজাম উদ্দিন কায়সার এই হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিনের শ্যালক। তাই অনুমান করা যাচ্ছে বিএনপি'র ভোট বিভক্ত হবে, যাতে কপাল পুড়তে পারে মনিরুল হক সাক্কু। বিগত দুই বার কুমিল্লায় বিএনপি'র যে বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে তার উপর একক আধিপত্য বিস্তার করলেও এবার সে সুযোগ পাচ্ছেন না সাক্কু। বিগত দিনের প্রচার-প্রচারণায়ও বিএনপির তৃণমূলের উল্লেখযোগ্য অংশ কর্মীদের কায়সারের পাশে দেখা গেলেও সাক্কুর পাশে তৃণমূলের উল্লেখযোগ্য কাউকে দেখা যায়নি।
কুমিল্লা বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্বাচিত হওয়ার পর বিগত বছরগুলোতে সাক্কু বিএনপির রাজনীতি হতে কিছুটা দূরে ছিল, তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তৃণমূলে। অন্যদিকে কায়সারের অংশ বিএনপির রাজনীতিতে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বিএনপি'র ভোটব্যাঙ্কের বড় একটি অংশ কায়সারের ঝুলিতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে কায়সারের চমক দেখানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে, কুমিল্লার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বর্ষীয়ান লীগ নেতা আফজাল খান পরিবারের সাথে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব চলছে সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের। কুমিল্লা সিটির বিগত দুই নির্বাচনে মনোনয়ন যায় খান পরিবারের কাছে। দুইবারই হারের পর খান পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার সমঝোতা করে তাদের হারিয়ে দিয়েছেন। তবে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছে বাহাউদ্দীনের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী আরফানুল হক রিফাত। এরিমধ্যে রিফাতের পক্ষে ভোটের মাঠে নেমেছেন বাহা উদ্দিনের পরিবারের সদস্যরা। অপর দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী অভিযোগ করছেন আ ক ম বাহাউদ্দিন রিফাতের পক্ষে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছে। এমন নানা সমীকরণে চলছে ভোটের হিসাব-নিকাশ।
তবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য কুমিল্লার নগর ভবনের শীর্ষকর্তা কে হবেন তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ জুন পর্যন্ত। তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়ে সাক্কু হ্যাট্রিক করবেন নাকি রিফাত অথবা কায়সার প্রথমবারের মত নগরভবনে যাবেন?
শেষমুহুর্তে গরম প্রচারণার মাঠ
এদিকে শেষ সময়ে এসেও অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে প্রচারণায় বিরামহীন সময় পার করছেন প্রার্থীরা।অভিযোগের পাশাপাশি ভোটারদের মন জয়ে শেষবারের মত দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।
রোববার সদর হাসপাতাল, শাসনগাছা, ডায়াবেটিকস হাসপাতাল এলাকায় গণসংযোগ চালান আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি দুর্নীতির সাথে কখনোই জড়াবো না, আপনারা আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন। আমার প্রথম কাজ হবে জলাবদ্ধতা দূর করা, যানজট নিরসন করা। আমি এক বছরের মধ্যে এই কাজ করবো।
ঘোড়া প্রতীকের মেয়র প্রার্থী নিজামউদ্দিন কায়সারের প্রচারণা শুরু করেন নগরীর ৫নং ওয়ার্ড এলাকা থেকে। এসময় তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন মারফতে শুনছি স্থানীয় সংসদ ২০১৮ সালে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে সেভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিভিন্ন বহিরাগত লোকজন কে কেন্দ্রের সামনে রেখে, ভোটারদেরকে পাড়া মহল্লায় বাঁধা দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছে। তাই আমি নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করবো ভোটের দিন পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য শহর জুড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করার জন্য।রোববার (১২ জুন) কুমিল্লা নগরীর দারোগাবাড়ি এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালান মনিরুল হক সাক্কু। এসময় তিনি বলেন, নির্বাচনের শুরু থেকেই সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আমি ইসিতে অভিযোগ দিয়েছি। এর প্রেক্ষিতে তাকে এলাকা ছাড়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি এলাকা ছাড়ছেন না।
তিনি আরো বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পেয়েছি সিটি কর্পোরেশনের বাইরের লোকজন কুমিল্লায় এসে থাকছে। তারা কুমিল্লার ক্লাবসহ বিভিন্ন হোটেলে অবস্থান নিচ্ছে। তাদের এখানে অবস্থানের উদ্দেশ্য কী? আমরা ওয়ার্ক করার পর আমাদের কর্মীদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি আমি রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়েছি। আমি শুনতে পেয়েছি, নির্বাচনের দিন তারা সিটি কর্পোরেশনের চতুর্দিকের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে লোকজন এনে সিটি এলাকায় প্যানিক সৃষ্টি করবে- ভোটাররা যেন কেন্দ্রে যেতে দেরি করে, ভয় পায়।
অবশেষে সাক্কুর ১৮ দফা ইশতেহার
প্রথম থেকে এবার ইশতেহার দিবেন না বললেও রোববার কুমিল্লা নগরের নানুয়ারদীঘির পাড়ের নিজ বাসভবনে ১৮ দফার ইশতেহার ঘোষণা করেন মনিরুল হক সাক্কু। তার ইশতেহারের ১৮ দফা হলো- কুমিল্লা নগরের অবকাঠামো (সড়ক, জলাবদ্ধতা, যানজট নিরসন) উন্নয়ন, সড়কবাতি লাগানো, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বাজার, শপিং মল, ক্রীড়া ও খেলার মাঠ, বস্তিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, করোনার সময়ে ত্রাণ কার্যক্রম, নিরাপত্তা বিধান, মাদক সন্ত্রাস ও ইভটিজিংমুক্ত সমাজ, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মাননা প্রদান, পাঠাগার স্থাপন ও গৃহকর গণশুনানির মাধ্যমে নির্ধারণ।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ